গারাে পাহাড়ের নীচে (আমার বাংলা, উচ্চমাধ্যমিক)

গারাে পাহাড়ের নীচে

       চৈত্র মাসে যদি কখনও মৈমনসিং যাও, রাত্তিরে উত্তর শিয়রে তাকাবে। দেখবে যেন একরাশ ধোঁয়াটে মেঘে কারা আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। ভয় পাবার কিছু নেই আসলে ওটা মেঘ নয়, গারাে পাহাড়। গারাে পাহাড়ে যারা থাকে, বছরের এই সময়টা তারা চাষবাস করে। তাদের হাল নেই, বলদ নেই- তাছাড়া পাহাড়ের ওপর তাে শুধু গাছ আর পাথর।
bb

মাটি কোথায় যে চাষ করবে? তবু তারা ফসল ফলায়-নইলে সারা বছর কী খেয়ে বাঁচবে? তাই বছরে এমনি সময় শুকনাে ঝােপে ঝাড়ে তারা আগুন লাগিয়ে দেয়। সে কি যে-সে আগুন? যেন রাবণের চিতা-জ্বলছে তাে জ্বলছেই। বছরের এমনি সময় যেন বনজঙ্গলের গাছপালারাও ভয়ে শুকিয়ে কাঠ হয়ে থাকে। জঙ্গলে যখন আগুন লাগে তখন হয় মজা।

বনের যত দুর্ধর্ষ জানােয়ার প্রাণ নিয়ে পালাই-পালাই করে। বাঘ-অজগর, হরিণ-শুয়াের যে যেদিকে পারে ছােটে। আর পাহাড়ি মেয়ে-পুরুষরা সেই সুযােগে মনের সুখে হরিণ আর শুয়াের মারে। তারপর সন্ধেবেলা শিকার সেরে গােল হয়ে ঘিরে নাচ আর গান। এদিকে আস্তে আস্তে গােটাবন পুড়ে ছাই হয়ে যায়। পাথরের ওপর পুরু হয়ে পড়ে কালাে ছাইয়ের পলেস্তারা, তার ওপর বীজ ছড়াতে যা সময়।

দেখতে দেখতে সেই পােড়া জমির ওপর সবুজ রং ধরে-মাথা চাড়া দেয় ধান, তামাক, আর কত ফসল। আমরা এই লােকগুলাের এক কাছে থেকেও পর; শুধু জানি, উত্তর দিকের আকাশটা বছরের শেষে একবার দপ করে জ্বলে ওঠে-দূরের আশ্চর্য মানুষগুলাে তারপর কখন যে মেঘের রঙে মিলিয়ে যায় তার খবর রাখি না। কাছাকাছি গিয়েছিলাম একবার। গারাে পাহাড়ের ঠিক নীচেই সুসং পরগনা। রেললাইন থেকে অনেকটা দূরে। গাড়ি যাবার যে রাস্তা, সে-রাস্তায় যদি কখনও যাও কান্না পাবে। তার চেয়ে হেঁটে যেতে অনেক আরাম।

সুসং শহরের গা দিয়ে গেছে সােমেশ্বর নদী। শীতকালে দেখতে ভারি শান্তশিষ্ট-কোথাও কোথাও মনে হবে হেঁটেই পার হই। কিন্তু যেই জলে পা দিয়েছি, অমনি মনে হবে যেন পায়ে দড়ি দিয়ে কেউ টেনে নিয়ে যাচ্ছে। স্রোত তাে নয়, যেন কুমিরের দাঁত। পাহাড়ি নদী সােমেশ্বরী-সর্বদা যেন রেগে টং হয়ে আছে! তার চেয়ে ফেরি আছে, গােরু-ঘােড়া-মানুষ একসঙ্গে দিব্যি আরামে পার হও।

হিন্দুস্থানি মাঝির মেজাজ যদি ভালাে থাকে, তােমার কাছ থেকে দেশবিদেশের হালচাল জেনে নেবে। হয়তাে গর্ব করে বলবে, তার যে বিহারি মনিব, বাংলার সব ফেরিঘাটেরই সে মালিক। পাহাড়ের নীচে যারা থাকে, তারা আমাদেরই মতাে হালবলদ নিয়ে চাষ-আবাদ করে।

মুখচোখে তাদের পাহাড়ি ছাপ হাজং-গারাে-কোচ-বানাই-ডালু-মার্গান এমনি সব নানা ধরনের জাত। গারােদের আলাদা ভাষা; হাজং-ডালুদের ভাষা যদিও বাংলা, কিন্তু তাদের উচ্চারণ আমাদের কানে একটু অদ্ভুত ঠেকে। ত’-কে তারা ‘ট’ বলে, ‘ট’-কে ‘ত’; আবার ‘ড’-কে তারা ‘দ’ বলে, ‘দ’-কে ‘ড’। প্রথম শুনলে ভারি হাসি পাবে। ভাবাে তাে, তােমার কাকার বয়সের একজন হৃষ্টপুষ্ট লােক দুধকে ডুড বলছে, তামাককেটামাক। এ-অঞলের গারােদের ঘর দূর থেকে দেখলেই চেনা যায়। মাচা করে ঘর বাঁধা। মাচার ওপরে যেখানেই শােয়া, সেখানেই রান্নাবান্না সবকিছু। হাঁসমুরগিও এই উচ্চাসনেই থাকে। এটা হচ্ছে পাহাড়ি স্বভাব। বুননা জন্তুজানােয়ারের ভয়েই এই ব্যবস্থা।

এই অঞ্চলের হাজংরাই সংখ্যায় সব চেয়ে বেশি। হাজং’কথার মানে নাকি পােকা। তাদের মতে, পাহাড়তলীর এই অঞ্চলে হাজংরাই প্রথম আসে; আর তখন চাষবাসে তাদের জুড়ি নাকি আর কেউ ছিল না। পাহাড়ি গারােরা তাই তারিফ করে তাদের নাম দিয়েছে হাজং—অর্থাৎ চাষের পােকা। ধানের ক্ষেত দেখলে কথাটা বিশ্বাস না করে উপায় নেই। একটু কষ্ট করে যদি পাহাড়ে না তােক একটা টিলার ওপরেও ওঠো-নীচের দিকে তাকালে দেখবে পৃথিবীটা সবুজ। যতদূর দেখা যায় শুধু ধান আর ধান- একটা সীমাহীন নীল সমুদ্র যেন আহ্লাদে হঠাৎসবুজ হয়ে গেছে। এত ফসল,এত প্রাচুর্য-তবু কিন্তু মানুষগুলাের দিকে তাকালে মনে হয় জীবনে তাদের শান্তি নেই।

একটা দুষ্টু নি কোথাও কোন্ আনাচে যেন লুকিয়ে আছে। ধান কাটার সময় বাড়ির মেয়ে-পুরুষ সবাই কাস্তে নিয়ে মাঠে সুবে; পিঠে আঁটি-বাঁধা ধান নিয়ে ছােটো ছােটো ছেলের দল কুঁজো হয়ে খামারে জুটবে। কিন্তু মাঠ থেকে যা তােলে, তার সবটা ঘরে থাকে না। পাওনাগন্ডা আদায় করতে আসে জমিদারের পাইক-বরকন্দাজ। সে এক মজার ধাধা তখন তারা গালে হাত দিয়ে যেন বলে:

ড়ােই ধাঁধায় পড়েছি, মিতে-
ছেলেবেলা থেকে রয়েছি গ্রামে;
বারবার ধান বুনে জমিতে
মনে ভাবি বাঁচা যাবে আরামে।
মাঠ ভরে যেই পাকা ফসলে
সুখে ধরি গান ছেলেবুড়ােতে।
একদা কাস্তে নিই সকলে।
লাঠির আগায় পাড়া জুড়ােতে
তারপর পালে আসে পেয়াদা।
খালি পেটে তাই লাগছে ধাঁধা৷

গাঁয়ের আল-বাঁধা রাস্তায় লােহার-খুর-লাগানাে নাগরায় শব্দ হয় খট খটাখট-দূর থেকে বাঁশের মােটা লাঠির ডগা দেখা যায়। ছােটো ছােটো ছেলের দল ভয়ে মায়ের আঁচল চেপে ধরে। খিটখিটে বুড়িরা শাপমুন্নি দিতে থাকে। জমিদারকে টঙ্ক দিতে গিয়ে চাষিরা ফকির হয়। পঞ্চাশ-ষাট বছর আগে এ-অঞ্চলে জমিদারের একটা আইন ছিল-তাকে বলা হতাে হাতিবেগার। জমিদারের বেজায় শখ হাতি ধরার। তার জন্য পাহাড়ে বাঁধা হবে মাচা।

মাচার ওপর সেপাইসান্ত্রী নিয়ে নিরিবিলিতে বসবেন জমিদার; সেই সঙ্গে পান থেকে চুন না খসে তার ঢালাও ব্যবস্থা। আর প্রত্যেক গাঁ থেকে প্রজাদের আসতে হবে নিজের নিজের চালচিড়ে বেঁধে। যে জঙ্গলে হাতি আছে, সেই জঙ্গল বেড় দিয়ে দাঁড়াতে হবে। ছেলে হােক বুড়াে হােক কারাে মাপ নেই। যারা হাতি বেড় দিতে যেত, তাদের কাউকে সাপের মুখে, কাউকে বাঘের মুখে প্রাণ দিতে হতাে।

মানুষ কতদিন এসব সহ্য করতে পারে? তাই প্রজারা বিদ্রাহী হয়ে উঠল। গােরাচঁাদ মাস্টার হলেন তাদের নেতা। চাকলায় চাকলায় বসল মিটিং, কামারশালায় তৈরি হতে লাগল মারাত্মক অস্ত্রসস্ত্র। শেষ পর্যন্ত জমিদারের পল্টনের হাতে প্রজাদের হার হলাে। কিন্তু হাতি-বেগার আর চলল না এখনও চৈতননগরে, হিঙুরকোণায় গেলে খগ মােড়ল, আমুতাে মােড়লের বংশধরদের মুখে বিদ্রোহের গল্প শােনা যায়।

থুরথুরে বুড়াে যারা, তারা দুখ করে বলে, সেকালে সর্ষের ক্ষেতে আমরা লুকোচুরি খেলতাম; মাঠে এত ধান হতাে যে কাকপক্ষীরও অরুচি ধরত। গােয়ালে থাকত ষাট-সত্তরটা গােরু; নর্দমায় দুধ ঢালাই হতাে। আর এখন? এক ফোটা দুধের জন্যে পরের দুয়ােরে হাত পাততে হয়। একটা কথা আগে থেকে বলে রাখি। ও-অঞ্চলে যদি কখনও যাও, ওরা তােমাকে ‘বাঙাল’ বলবে। চটে যেয়াে না যেন। বাঙাল মানে বাঙালি। বাংলাদেশে থাকলেও ওদের আমরা আপন করে নিইনি-তাই ওরাও আমাদের পর-পর ভাবে। অথচ আমরা সবাই বাংলাদেশেরই মানুষ।


[su_posts posts_per_page=”10″ tax_term=”3″ order=”desc”]