জল, বায়ু ও শব্দদূষণ এবং তার প্রতিকার রচনা

জল, বায়ু ও শব্দদূষণ এবং তার প্রতিকার

ভূমিকা :

একবিংশ শতাব্দীর বর্তমান প্রজন্মের কাছে পরিবেশ দূষণ এক জ্বলন্ত সমস্যা। আমাদের জীবনের সঙ্গে প্রকৃতি ও পরিবেশের সম্পর্ক অঙ্গাঙ্গী। কারণ প্রকৃতি থেকে বিশুদ্ধ জল ও তাজা বায়ু আমাদের জীবনধারণের পক্ষে একান্ত প্রয়োজনীয়। পৃথিবীতে জীবন বিকাশ সম্ভব হয়েছিল এই বিশুদ্ধ জল আর বায়ুর জন্য। কিন্তু আজ নানা কারণে সেই পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। পরিবেশ বিজ্ঞানীরা ক্রমবর্ধমান
এই দূষণ নিয়ে চিন্তিত।

পরিবেশ দূষণ কী :

প্রকৃতির যে সমস্ত জৈব ও অজৈব উপাদান উদ্ভিদ ও প্রাণীর কার্যকলাপকে নিয়ন্ত্রিত করে তারাই একত্র হয়ে গড়ে তোলে পরিবেশ। কাজেই পরিবেশের মাটি, জল, হাওয়া যেমন উপাদান; তেমনই গাছ, পশুপাখি, মানুষ প্রভৃতিও এক একটি উপাদান। এই উপাদানগুলি যখন পৃথকভাবে বা একত্রে দূষিত হয় তখন তা পরিবেশ দূষণের পর্যায়ে পড়ে। দূষণ হল পরিবেশের একটি পরিবর্তন, মানুষেরই পরিত্যাজ্য বস্তু বা পরিত্যাজ্য ও উদ্বৃত্ত শক্তিই পরিবেশের স্বাভাবিক কাজকর্মকে ব্যাহত করে। আজকের যন্ত্রসভ্যতার প্রসারের যুগে পরিবেশ দূষণ নানাভাবে আমাদের প্রভাবিত করছে। তেজস্ক্রিয় দূষণও আজকের বিশেষ সমস্যা।

স্বরূপ :

পরিবেশ ছাড়া মানুষ বাঁচতে পারে না। বাঁচার উপকরণ আমরা পরিবেশ থেকে গ্রহণ করি। যে অক্সিজেন আমাদের প্রাণ বাঁচায়, যে খাদ্য খেয়ে আমরা বেঁচে থাকি—তা এই পরিবেশের দান। কিন্তু এই পরিবেশকে আমরা বদলে দিচ্ছি। বন কেটে বসত বাড়ি নির্মাণ করছি, রাস্তাঘাট তৈরি করছি, প্রকৃতির সঙ্গে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করছি, নিজেদের প্রাত্যহিক ব্যবহারের জন্য যথেচ্ছভাবে প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহার করছি, অথচ ভারসাম্যের কথা আদৌ ভাবছি না। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে একদিকে বিজ্ঞানের অফুরন্ত দান গ্রহণ করছি অন্যদিকে দূষণের দুঃস্বপ্ন আমাদের সন্ত্রস্ত করছে। বায়ু দূষিত হচ্ছে, জল দূষিত হচ্ছে, দূষিত হচ্ছে শব্দও ।

বায়ুদূষণ :

পরিবেশ দূষণের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয় জল, বায়ু ও শব্দ। সৃষ্টি হয় জলদূষণ, বায়ুদূষণ ও শব্দদূষণের। মানুষ যেদিন প্রথম আগুন জ্বালাতে শিখেছিল সেদিন থেকে দূষিত হতে শুরু হয়েছিল বায়ু। যানবাহনের ধোঁয়ার দ্বারা পরিবেশ দূষিত হতে লাগল । কার্বন-ডাই-অক্সাইড, কার্বন-মনোক্সাইড প্রভৃতি গ্যাস বায়ুকে দূষিত করে দিল। প্রযুক্তি বিদ্যার যুগে বাষ্পশক্তির জন্য বয়লার জ্বলল, বিদ্যুৎ শক্তির জন্য বড়ো বড়ো থার্মাল ইউনিট হল, আণবিক শক্তি উৎপাদনের জন্য বড়ো বড়ো কলকারখানা বসল এবং তার ধোঁয়া বাতাসকে দূষিত করল। ইট তৈরির জন্য চিমনির মাধ্যমে ধোঁয়া পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করল। আণবিক পারমাণবিক বোমার স্পর্ধিত মৃত্যুকণা ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে আকাশে-বাতাসে, পলিথিনের পর্যাপ্ত ব্যবহার বায়ুমণ্ডলের ভারসাম্যকে নষ্ট করে।

বায়ুদূষণের প্রতিকার :

বায়ুদূষণের প্রতিকারকল্পে প্রথমেই প্রয়োজন সার্বিক সচেতনতা। কলকারখানা, যানবাহন প্রভৃতিকে বায়ুদূষণের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট নিয়মাবলীর আওতায় ফেলে সে সব বিধি তারা মানছে কি না তা দেখে শিল্পসমৃদ্ধ নগরগুলিকে চিহ্নিত করে সেগুলির ক্ষেত্রে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ, যাতে সেইসব নগরীগুলি থেকে লোকালয় দূরে থাকে তা দেখা। কিম্বা ঐসব নগরীর লোকেদের দূষণজনিত রোগগুলি সম্বন্ধে সচেতন করানো। ধোঁয়াশার হাত থেকে কিভাবে মানুষ মুক্তি পেতে পারে—এ ব্যাপারে ইতিবাচক পদক্ষেপ নেওয়াও জরুরি।

জলদূষণ ও প্রতিকার :

আমরা সবাই জানি, জলের অপর নাম জীবন। কিন্তু সেই জল যদি দূষিত হয়ে পড়ে তাহলে জীবনে নেমে আসে সংকট। নদীর তীরে অজস্র কলকারখানা থাকায় সেখানকার বর্জ্য পদার্থ জলে মিশে জলকে দূষিত করছে। গ্রামাঞ্চলের মানুষ পুকুরের জলে স্নান কিম্বা পুকুরের পাড়ে প্রস্রাব পায়খানা করছে। জলের সঙ্গে এগুলির সংস্রব ঘটছে। পুকুরের সেই জলে মুখ হাত ধুচ্ছে এবং জীবাণু চলে যাচ্ছে শরীরে। এই দূষণ থেকেও মানুষকে মুক্ত করতে হলে প্রয়োজন সচেতনতা। চেতনার উন্মেষেই যে কোনো অশুভ শক্তিকে দূর করা যায়। শুধু নিয়ম বা আইন করলেই হবে না, আইন যাতে সবাই মান্য করে তা দেখাও জরুরি।

শব্দদূষণের প্রকৃতি :

বায়ুদূষণ এবং জলদূষণের সঙ্গে সঙ্গে শব্দদূষণও আমাদের পশ্চিমবঙ্গের পরিবেশকে দূষিত করে তুলছে। রাস্তাঘাটে মোটরগাড়ির হর্ণ, কলকারখানার আওয়াজ, বাজি, বোমা, রেডিও, টেলিভিশন, মিছিলের ধ্বনি-প্রতিধ্বনি, মাইকের অমায়িক চড়া সুর, উৎসব-অনুষ্ঠানে লাউড স্পিকারের মাত্রাতিরিক্ত আওয়াজ, রাত্রে বিভিন্ন জলসায় অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতির সহযোগে গানের নামে চিৎকার সাধারণ মানুষের শ্রবণেন্দ্রিয়কে পীড়িত করছে।

শব্দদূষণের কারণ :

এই শব্দদূষণের কারণ কী—এ নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। এর অন্যতম কারণ হল মানুষের সচেতনতা বাড়ছে, সেই সঙ্গে সহ্যের সীমাও সংকুচিত হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, আজকাল বেশিরভাগ নাগরিকই কর্তব্য বা দায়িত্ব সম্বন্ধে সচেতন নয়। তৃতীয়ত, নিজেকে জাহির করার প্রবণতা বেশিরভাগ মানুষকেই পেয়ে বসেছে। আমার যা আছে তা সকলকে জানাতে চাই আমরা, তাই সেক্ষেত্রে পরিধির কথা মনেই আসে না। স্বাভাবিকভাবেই সীমা লঙ্ঘিত হয়। চতুর্থত, বিভিন্ন জলসায় বা অনুষ্ঠানে যে ধরনের যন্ত্র ব্যবহার করা উচিত তার চেয়ে বেশি শক্তিশালী যন্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে—তাই দূষণের পর্যায়ে চলে যাচ্ছে।

শব্দদূষণ ও প্রতিকার :

শব্দদূষণের প্রতিকারকল্পে সর্বাগ্রে প্রয়োজন সঠিক সচেতনতা, নাগরিকদের দায়িত্ববোধ। দ্বিতীয়ত, সবকিছুর সীমা আছে। তাই সেই পরিধি মেনে লাউড স্পিকারের, বাজির ব্যবহার একান্ত বাঞ্ছনীয়। তৃতীয়ত, জলসার ক্ষেত্রে যে আইন করা হয়েছে—তা যথাযথ পালন করা হচ্ছে কি না দেখতে হবে। চতুর্থত, প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও প্রশাসনিক স্তরে দায়িত্ব যথাযথ পালন করা। কেননা কলকাতায় বাজির শব্দ কালীপূজার সময় সীমা মেনে ফাটানো হলেও গ্রামাঞ্চলে উপযুক্ত প্রশাসনের অভাবে কোথাও কোথাও কান ফাটানো বাজির আওয়াজ শোনা গেছে। তাই প্রশাসনিক স্তরে দায়িত্বগুলি ঠিকঠাক পালিত হচ্ছে কি না, এজন্য উচ্চ পর্যায়ের ‘মনিটারিং সেল’ খোলা প্রয়োজন। পঞ্চমত, শুধু আইন করে এর প্রতিকারের ব্যবস্থা করা যাবে না। সেজন্য প্রয়োজন যথার্থ পরিকল্পনা। নতুন নতুন নগর যখন গড়ে উঠছে সেখানে জলসার জন্য কমিউনিটি হল রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। ষষ্ঠত, শব্দদূষণের ফলে কি হচ্ছে, কি হতে পারে-সে ব্যাপারে গণমাধ্যমকে একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিতে হবে। সেমিনার করে, লিফলেট বিলি করে, বেতার ও দূরদর্শনে বিভিন্নভাবে প্রচার করে সাধারণ মানুষকে এ ব্যাপারে সচেতন করা যেতে পারে। এমনকি একদম ছেলেবেলা থেকে বিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমে রাখা উচিত শব্দের অপব্যবহার সম্পর্কে সচেতনতার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা।

অন্যান্য দূষণ :

এছাড়া অতিরিক্ত ও যথাযথ ব্যবহারের অভাবে ভূমি দূষণ হচ্ছে। হচ্ছে গন্ধ দূষণ। বিভিন্ন বর্জ্য ও আবর্জনা থেকে গন্ধ দূষণ হচ্ছে। বিভিন্ন হোর্ডিং, ট্যাবলো, টিভি-র পর্দায় উপস্থাপিত দৃশ্যও দূষণ সৃষ্টি করছে। বিশ্বব্যাপী পারমাণবিক শক্তির হুঙ্কার পারমাণবিক দূষণ সৃষ্টি করছে। ফলে বহু বিকলাঙ্গ শিশুর জন্ম হচ্ছে। সেই সঙ্গে সৃষ্টি হচ্ছে মানসিক দূষণ এবং সামাজিক দূষণ যা মানুষের সামাজিক সত্তা তথা বেঁচে থাকার ইচ্ছাটাকে অপসৃত করছে।

উপসংহার :

দূষণ এখন পরিবেশ থেকে আমাদের মনের মধ্যে বাসা বেঁধেছে। সাম্প্রতিক সমীক্ষা অনুযায়ী, ভারতবর্ষে পূর্বাপেক্ষা দূষণের হার কমেছে। তা কিন্তু আশ্বস্ত হওয়ার পক্ষে যথেষ্ট নয়। কেননা, যা প্রচার করা হচ্ছে কিম্বা দূষণ প্রতিরোধ করার জন্য যে অর্থ বরাদ্দ হচ্ছে তার খরচের ক্ষেত্রেও দূষণ। তাই এজন্য চাই সার্বিক ইতিবাচক মনোভাব ও সদিচ্ছা।

এ অনুসরণে লেখা যায় :
জলদূষণ : স্বরূপ ও প্রতিকার।
বায়ুদূষণ : কারণ ও প্রতিকার।
শব্দদূষণ : কারণ ও প্রতিকার।

__________

Your Queries:

জল দূষণ ও তার প্রতিকার রচনা
জল দূষণ ও তার প্রতিকার pdf
জল দূষণ রচনা
জল দূষণ প্রজেক্ট ভূমিকা
জল দূষণ ও তার প্রতিকার project
জল দূষণ প্রজেক্ট pdf
জল দূষণ ভূমিকা
জল দূষণ প্রকল্প
জল দূষণ কারণ
জল দূষণ প্রবন্ধ রচনা
পরিবেশ দূষণ ও তার প্রতিকার অনুচ্ছেদ রচনা
বায়ু দূষণ ও তার প্রতিকার
পরিবেশ দূষণ ও তার প্রতিকার প্রতিবেদন
পরিবেশ দূষণ ভূমিকা
পরিবেশ দূষণ ও তার প্রতিকার ছাত্র ছাত্রীদের ভূমিকা
পরিবেশ দূষণ ও তার প্রতিকার for class 7
পরিবেশ দূষণ ও তার প্রতিকার রচনা pdf
পরিবেশ দূষণ ও তার প্রতিকার রচনা for class 3
পরিবেশ দূষণ ও তার প্রতিকার রচনা hsc
জল দূষণ প্রজেক্ট pdf
পরিবেশ দূষণের ফলাফল
পরিবেশ দূষণের কারণ ও ফলাফল
বায়ু দূষণ প্রজেক্ট pdf
পরিবেশ দূষণ রোধের উপায়
পরিবেশ দূষণ ভূমিকা
পরিবেশ দূষণের ৫ টি কারণ লেখ
পরিবেশ দূষণ বলতে কী বোঝ

বায়ু ও শব্দদূষণ