সন্ত মাদার টেরিজা বাংলা রচনা | Bengali Essay on Mother Teresa

 সন্ত মাদার টেরিজা

ভূমিকা :

রবীন্দ্রনাথের একটি কবিতায় আছে—শ্রাবস্তীপুর নগরে যখন দুর্ভিক্ষের কালো ছায়া নেমে এসেছে; এক মুঠো অন্নের জন্য যখন বুকফাটা কান্না তখন তথাগত বুদ্ধ তার শিষ্যদের ডেকে আদেশ দিলেন, ‘তোমাদের কাউকে দুর্ভিক্ষ-পীড়িত এই নগরবাসীদের অন্ন যোগাবার ভার নিতে হবে। ক্ষুধার্তের এই ক্রন্দন আমি আর সহ্য করতে পারছি না।’ সে সময় সমবেত শিষ্যদের মধ্যে একাধিক ধনাঢ্য প্রতিপত্তিশালী ব্যক্তিরা উপস্থিত থাকলেও কেউই তাঁর আহ্বানে এগিয়ে এলেন না; একমাত্র এগিয়ে এলেন অনাথপিন্ডদের মেয়ে সুপ্রিয়া। সবাই তখন বিস্মিত হয়ে সুপ্রিয়াকে প্রশ্ন করলেন, ‘কোথায় তোমার অন্নভাণ্ডার’? মধুর হেসে সুপ্রিয়া বললেন, ‘কেন? তোমাদেরই ঘরে ঘরে। তোমাদের ভিক্ষার দানেই আমি আমার ভাণ্ডার পূর্ণ রাখব’। সুপ্রিয়া সেইমতো ভিক্ষালব্ধ অন্নে ক্ষুধার্ত শ্রাবস্তীপুরের সেবায় আত্মনিয়োগ করেছিলেন। আর মা টেরিজা নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেছেন শুধু ক্ষুধার্তের জন্য নয়—বিশ্বব্যাপী তাবৎ আর্তজনের সেবায়।

জীবনের প্রথম পর্ব :

মাদার টেরিজার জন্ম হয় ১৯১০ সালের ২৬ আগস্ট যুগোস্লোভিয়ার স্কপিয়ে শহরে। নাম দেওয়া হয়েছিল অ্যাগনেশ গোনশা বোজাশিউ। তাঁর বাবা পেশায় ছিলেন কৃষক এবং জাতিতে আলবানীয়। মাদার অবশ্য বলতেন তাঁর জন্মদিন ২৭ আগস্ট, কারণ ওইদিন তাঁর খ্রিস্টধর্মে দীক্ষা। সাত বছর বয়সে বাবার মৃত্যু ও প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর কালে পৃথিবীব্যাপী হাহাকার মাদারের শিশু ও কিশোর মনকে নাড়া দেয়। স্কুলে পড়ার সময়ই তিনি সেবাধর্মে দীক্ষিত হন। ১৯২৮-এ সন্ন্যাসিনীর ব্রত গ্রহণ করে পরের বছর চলে এলেন দার্জিলিং-এ, যেখানে স্কুলে শিক্ষিকা হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। এরপর চলে আসেন কলকাতায়।

দ্বিতীয় পৰ্ব :

কলকাতার এন্টালিতে সেন্ট মেরিজ হাইস্কুলে ভূগোলের শিক্ষিকা হিসেবে তিনি কাজ শুরু করেন, পরে যোগ দেন লরেটো স্কুলে, এভাবে কেটেছে সতের বছর। এই সময় কলকাতার মতিঝিল বস্তির দুঃস্থ ও দুর্গত মানুষদের দেখে কলকাতার দারিদ্র্যের রূপ উপলব্ধি করেন। তাছাড়া তিনি উপলব্ধি করেছেন বাংলার ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পরিস্থিতি, দেশবিভাগ প্রভৃতি। তাই ১৯৫২-তে কলকাতার কালীঘাটে মাদার প্রথম দরিদ্রদের জন্য হোম খোলেন, যার নাম দেন ‘নির্মল হৃদয়’। হতদরিদ্র এবং দুরারোগ্য মানুষ এখানে আশ্রয় এবং চিকিৎসা পেতেন। এই সময়েই টিটাগড়ে কুষ্ঠরোগীদের জন্য তিনি একটি আশ্রম খুলেছিলেন। ১৯৬৫-তে দরিদ্রদের জন্য ভারতের বাইরে প্রথম আশ্রমটি খোলেন ভেনেজুয়েলায়, ১৯৭১-এ মিশনারী কাজকর্মের জন্য নিউইয়র্কে একটি কেন্দ্র খোলেন। এখন পৃথিবী জুড়ে মিশনারিজ অব চ্যারিটি-র প্রায় সাড়ে চার হাজার সন্ন্যাসিনী এবং লক্ষ লক্ষ স্বেচ্ছাসেবী কাজ করে চলেছেন। ৫ সেপ্টেম্বর, ১৯৯৭-তে তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুর পরেও তাঁর কাজ থেমে নেই। তাঁর সেবাধর্ম, মমত্ববোধ ও অনন্য মনুষ্যত্ব বিশ্ববাসীর কাছে অনুকরণীয় হয়ে থাকবে।

পুরস্কার :

তিনি ১৯৭৯-তে শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কারে পুরস্কৃত হন। এই পুরস্কারের অর্থ তিনি আর্তদের সেবায় উৎসর্গ করেছেন। নোবেল ছাড়াও ১৯৬২-তে ‘পদ্মশ্রী’, ১৯৭২-এ ‘নেহেরু’ পুরস্কার, ১৯৮০-তে ‘ভারতরত্ন’ উপাধি এবং বিশ্বভারতীর ‘দেশিকোত্তম’ উপাধি পান। এছাড়া ম্যানিলা থেকে পেয়েছেন ‘ম্যাগসাইসাই’, ভ্যাটিকান সিটি থেকে ২৩-তম পোপ জন পুরস্কার। জাতির

সন্ত ঘোষণা :

৪ঠা সেপ্টেম্বর, ২০১৬-তে রোমের ভাটিক্যান শহরে বিশ্বের বহু মানুষের উপস্থিতিতে পোপ মাদার টেরেসাকে ‘সন্ত’ হিসেবে ঘোষণা করেন। মনিকা বেসরাকে কেন্দ্র করে অলৌকিক কাণ্ডের জন্য ও অন্যান্য কারণে অলৌকিক শক্তির অধিকারিণী মাদারকে এই উপাধিতে ভূষিত করেন পোপ। এরপর থেকে মাদার টেরেজা হয়ে গেলেন ‘সন্ত টেরিজা’। তাঁর সেবা ও মানবতার যথার্থ উপহার তাঁকে সন্ত রূপেই প্রতিপন্ন করেছিল, পোপ এটিকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিলেন মাত্র। অন্য দেশের মতো ভারত থেকে এবং পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রতিনিধি দল এই অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন যার মধ্যে আমাদের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় উপস্থিত থেকে মাদারের কীর্তিকে স্মরণ করেন শ্রদ্ধার সঙ্গে। আমাদের কলকাতার মাদার বিশ্ববাসীর কাছে পরিচিতি পেলেন সন্ত হিসেবে—এই গর্ব আমাদের রাজ্যকে বিশ্ববাসীর কাছে পৌঁছে দিল।

চরিত্র মাহাত্ম্য :

টেরিজার কাছে জীবসেবাই শিব সেবা। আর্ত মানুষকে সেবার মধ্যেই তিনি পেয়েছেন তাঁর ঈশ্বরকে। তিনি খ্রিস্টান ক্যাথলিক ধর্মে দীক্ষিত হলেও সমস্ত জাতি-ধর্ম-বর্ণের ঊর্ধ্বে। তিনি জোর করে কাউকে ধর্মান্তরিত করেন নি। স্নেহময়ী জননীর স্বরূপ তাঁর অন্তরে। এমন নিঃস্বার্থ সেবা, এমন অক্লান্ত কর্মপ্রচেষ্টা, অখণ্ড আত্মবিশ্বাস, ঐকান্তিক ভক্তি অথচ শিশুর মতো সহজ সরলতা মানব ইতিহাসে খুব কমই দেখা গেছে। বঙ্কিমচন্দ্র বলেছিলেন, ‘পুষ্প আপনার জন্য প্রস্ফুটিত হয় না’। মাদার টেরিজাও ঠিক তাই—যিনি নিজের জীবনকে অপরের সেবায় নিয়োজিত করেছেন। অনাথ, আতুর, দুঃস্থ ও রোগগ্রস্ত মানুষকে নিঃশর্ত ও নিঃস্বার্থভাবে সেবা করে তিনি মানবতার এক অভিনব দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।

উপসংহার :

মাদার আর্তজনের সেবায় যেসব প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন তা বিশ্বব্যাপী মানুষের সাগ্রহ দানে। তিনি প্রমাণ করেছেন স্বার্থপর আত্মকেন্দ্রিক জগতে তিনি এক ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্ব। বিশ্বজুড়ে যেখানে স্বার্থে -স্বার্থে সংঘাত, বিদ্বেষ আর হানাহানি সেখানে মানুষের হৃদয়ই পারে এই বর্তমান হতাশাময় জগৎ থেকে মুক্তি দিতে। মাদার টেরিজা তাঁর মাতৃহৃদয় দিয়ে প্রমাণ করেছেন, হিংসা ও স্বার্থের দ্বন্দ্ব থেকে মানুষের হৃদয়ধর্ম ও মনুষ্যত্ব বোধ অনেক ঊর্ধ্বে। তাই টেরিজার সেবা, শান্তি ও করুণা আজ বিশ্বের দরবারে স্বীকৃত। সব দিক দিয়ে তিনি এক মূর্তিমতী জীবন্ত বিগ্রহ।

_________

Your Queries:

মাদার তেরেসার জীবনী বাংলায়
মাদার টেরিজা ছবি
মাদার তেরেসার পুরো নাম কি
মাদার তেরেসা সম্পর্কে ১০ টি বাক্য
মাদার তেরেসা কি বিয়ে করেছিলেন
মানব সেবায় মাদার তেরেসার অবদান
মাদার তেরেসা কেন বিখ্যাত
মাদার তেরেসার সমালোচনা
মাদার টেরিজা অনাথ আশ্রম