ছাতির বদলে হাতি(আমার বাংলা উচ্চমাধ্যমিক)

[su_heading size=”21″]ছাতির বদলে হাতি[/su_heading]

        নাকের বদলে নরুন পেলাম টা ডুমাডুম ডুম। কিন্তু শুধু একটা ছাতির বদলে এক নয়, দুই নয় একবারে তিন বারােং ছত্রিশ বিঘে জমি-নাকের বদলে নরুন তাে তার কাছে কিছুই নয়। বিশ্বাস না হয়, বেশ, একবার হালুয়াঘাট বন্দরে যেয়াে। সেখানে মনমােহন মহাজনের গদিতে গেলেই বুঝবে কী তেজ বন্ধকি-তেজারতির। মনমােহন মহাজন গত হয়েছেন অনেক দিন; কিন্তু সেই মহাজনের পন্থা আজও টিকে আছে। পঁচিশ-ত্রিশ বছর আগেকার কথা। হা

লুয়াঘাট বন্দরে গারাে পাহাড়ের নীচের এক গাঁ থেকে সওদায় এসেছিল এক গারাে চাষি। নাম তার চেংমান। এমন সময় দেও-দেবতা স্তম্ভিত, দিক-পৃথিবী কম্পিত করে মুষলধারে বৃষ্টি। সে বৃষ্টি ধরবার কোনাে লক্ষণই নেই। এদিকে দিন তাে হেলে, রাত তােটলে-বাড়ি ফেরার উপায় কী?মনমােহন মহাজনের দোকানের ঝাঁপির নীচে চেংমান আশ্রয় নিয়েছিল। হঠাৎ মহাজন যেন করণার অবতার হয়ে উঠল। একেবারে খাস কলকাতা থেকে খরিদ-করে আনা আনকোরা নতুন একটা ছাতা চেংমানের মাথার ওপর মেলে দিয়ে মনমােহন বলল :‘যা যা, ছাতিটা নিয়ে বাড়ি চলে যা।

নিজে ভিজিস তাতে কিছুনয়, কিন্তু এতগুলাে পয়সার সওদা যে ভিজে পয়মাল হয়ে যাবে। মহাজনের দরদ হঠাৎকীসে এত উতলে উঠল? চেংমান দোমনা হয়ে ভাবছে নেব কি নেব না। নিশ্চয় অনেক দাম। হাতে পয়সাও তাে নেই। নগদ পয়সানাইবা দিলে।যখন তােমারসুবিধে হবে দিয়ে গেলেইহলাে। ওর জন্যে কিছুভেবােনা।’-মনমােহন ভরসা দেয়।

চেংমান ভাবল এমন সুযােগ ছাড়া উচিত নয়। নতুন ছাতি মাথায় দিয়ে মহাফুর্তিতে বাড়ির দিকে সে চলল। ছেলে-পুলে-বউ তার পথ চেয়ে বসে আছে। চেংমান গেলে তবে হাঁড়ি চড়বে। চেংমান ফি বার হাটে যায়। মনমােহনকে বলে, “বাবু, পাওনাগন্ডা মিটায়ে নেন। মনমােহন ফি বারই বলে আহা-হা অত তাড়া কীসের, সে দিও ক্ষণ পরে।

এমনি করে বছর, তারপর বছর যায়। ধার করে ছাতি কেনার কথা চেংমান ভুলেই গেল। হঠাৎ একদিন হাটবারে মনমােহন চেংমানকে পাকড়াও করে। -কী বাছাধন, বড়াে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছ। পাওনা মিটিয়ে দিয়ে যাও।মনমােহনের কথায় চেংমানের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। চেংমান বুঝতে পারে এবার সেইঁদুরকলে পড়েছে। মনমােহন তার লাল খেরােয় বাঁধানাে জাবদা খাতা বার করে যা পাওনা হিসেব দেখাল, তাতে চেংমানের চোখ

কপালে উঠল। এই ক-বছরে চক্রবৃদ্ধিহারে ছাতির দাম বাবদ সুদসমেত পাওনা হয়েছে হাজার খানেক টাকা। প্রায় একটা হাতির দাম। বিশ্বাস করাে, বানানাে গল্প নয়। যদি যাও ও-অঞ্চলে, পাকাচুল প্রত্যেকটা ডালু-হাজং-গারাে চাষি এর সাক্ষী
দেবে। ডালুদের গ্রাম কুমারগাঁতির নিবেদন সরকারের মুদিখানায় দু-দশ বছর বাকিতে মশলাপাতি কেনার জন্যে। নিবেদনের ছেষট্টি বিঘে জমি মহাজন কুটির সাহা এমনিভাবে দেনার দায়ে কেড়ে নিয়েছে।

আরেক ধুরন্ধর মহাজন এক চাষিকে ধারে কোদাল দিয়ে পরে তার কাছ থেকে পনেরাে বিঘে জমি মােচড় দিয়ে নিয়েছিল। ও-অঞলের পঞ্চাশটা গ্রামে ডালুদের বাস। কথাবার্তায় পােশাক-পরিচ্ছদে হাজংদের সঙ্গে এদের খুব বেশি মিল। কে ডালু, কে হাজং বােঝাই যায় না। কিন্তু ডালুদের জিজ্ঞেস করাে, ওরা বলবে-হাজংরা জাতে ছােটো। হাজংরাও আবার ঠিক উলটো বলবে। ডালুরা বলে, সে দিন আর নেই। আগে ছিল তারা অন্ধ বােকার জাত। পাহাড়ের নীচে যেদিন থেকে লাল নিশান খুঁটি গেড়েছে, সেই দিন থেকে তাদের চোখ ফুটেছে। সে এক দিন ছিল বটে। শুধু মনমােহন মহাজন আর কুটিশ্বর সাহাই নয়- ছিল জোতদার আর তালুকদারদের

নিরঙ্কুশ শাসন। আর সেই সঙ্গে ব্রিটিশ সিংহের দাপট। সিংহ-যার ভালাে নাম পশুরাজ। জমিদারের খামারে জমির ধান তুলতে হবে। জমিদারের পাওনা মিটিয়ে তবে চাষি তার ঘরে ধান নিয়ে যেতে পারত। চুক্তির ধান তাে বটেই, কার ওপর কর্জার ধান শােধ দিতে হতাে টাকায় এক মণ হিসেবে। তাছাড়া আছে। হাজার রকমের বাজে আবওয়াব। অথাৎ খাজনার চেয়ে বাজনা বেশি। যেচাষি বকের রক্ত জল করে এত কষ্টে ফসল ফলাল শেষটায় তাকে শুধু পালা হাতে করে ঘরে ফিরতে হতাে। এদিকে আর একরকমের প্রথা আছে-নানকার প্রথা।নানকার প্রজাদের জমিতে স্বত্ব ছিল না। জমির আমকাঠালে তাদের অধিকার ছিল না।

জমি জরিপের পর আড়াই টাকা পর্যন্ত খাজনা সাব্যস্ত হতাে। খাজনা দিতে না পারলে তহশিলদার প্রজাদের কাছারিতে ধরে নিয়ে যেত, পিছমােড়া করে বেঁধে মারত; তারপর মালঘরে আটকে রাখত। লামে সব সম্পত্তি খাস করে নিত মহাজনেরা কর্জা ধানে এক মণে দু-মণ সুদ আদায় করত। কিন্তু নওয়াপাড়া আর দুমনাকুড়া, ঘােষপাড়া আর ভুবনকুড়ার বিরাট তল্লাটে ডালু চাষিরা আজ জেগে উঠেছে। তারা বলেছে, জমিদারের খামারে আমরা ধান তুলব না। ধান তারা তােলেনি। পুলিশ-কাছারি কিছুতেই কিছুহয়নি। শেষে জমিদার হার মেনেছে। আজ তারা গর্ব করে বলে, বন্দরের ভদ্রলােকেরা আজ আর আমাদের তুই-তুকারি করতে সাহস পায় না।

‘আপনি’বলে সম্ভাষণ করে। থানায় চেয়ার ছেড়ে দেয় বসতে। আমরাও অনেক সভ্য হয়েছি। আগে বাপ-ছেলে একসঙ্গে বসে মদ খেত, এখন মদ খাওয়া সমাজের চোখে খুবই লজ্জার বিষয়। হালবলদের অভাবে চাষ-আবাদের আজকাল বেজায় মুশকিল। এখানকার চাষিরা তাই সবাই মিলে গাঁতায় চাষ করে। চাষ করতে করতে ওরা ছেলেমেয়েরা মিলে গান ধরে :

শুনাে শুনাে বন্ধু গাে ভায়া
রােয়া লাগাইতে চলােগাে এলা।
বন্ধুর জমিখানিদাহাকোণা
হাল জরিছে মৈষমেনা
হাল বাে আছে
নিউথি মাতি রে
কত বালাগাব নিতি নিতি,..

চলাে বন্ধ! এখন রােয়া লাগাতে যাই। পাহাড়ের নীচে আমাদের জমি; হালের ভারে মােষের শিং নয়ে পড়েছে। আমরা হাল বাইছি ভাই, আমরা হাল বাইছি। কিন্তু কঠিন মাটি উঠতে চায় না। কী কষ্ট! কী কষ্ট! যারা এত কষ্ট করে আমাদের মুখে অন্ন জোগায়-ইচ্ছে করে, জমিদারের হাত থেকে বাংলার সমস্ত জমি তাদের হাতে দিই, মহাজনের নিষ্ঠর ঋণের বােঝা থেকে তাদের মুক্তি দিই। তােমাদের কি ইচ্ছে হয় না?


[su_posts template=”templates/single-post.php” tax_term=”3″ order=”desc”]