স্বামী বিবেকানন্দের চিকাগাে বক্তৃতার একশ পঁচিশ বছর

[su_posts template=”templates/list-loop.php” posts_per_page=”2″ tax_term=”1392″ order=”desc” orderby=”rand”]

স্বামী বিবেকানন্দের চিকাগাে বক্তৃতার একশ পঁচিশ বছর

ভূমিকা :

চিকাগাে বক্তৃতার ১২৫ বছর পরে ঠাকুর শ্রীরামকৃয়ের সুযােগ্য শিষ্য কর্মবীর ও সাধারণ মানুষের সেবায় নিয়ােজিত প্রাণ বিবেকানন্দের আদর্শ ও চিন্তাধারা বর্তমান বস্তু-সর্বস্ব কৃত্রিম জীবনে অনুধ্যানের প্রয়ােজন উপলব্ধ হচ্ছে।

কেননা সন্ন্যাসী বিবেকানন্দ ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দে আমেরিকা ধর্মমহাসম্মেলনে আধ্যাত্মিক ভারতবর্ষের প্রতিনিধি হয়ে বজ্রনির্ঘোষ কণ্ঠে তার ভাষণ রেখেছিলেন, সময়টা ভারতবর্ষ তথা বিবেকানন্দের পক্ষে ছিল দুঃসময় যখন পরধর্ম অসহিষ্ণুতার বিষনিঃশ্বাসে পৃথিবী জর্জরিত।

বর্তমান সমাজেও যে ধর্মীয় গোঁড়ামি, সাম্প্রদায়িকতাজনিত সংকট, স্বার্থপরতা ও সুবিধাবাদের মহামিলন ঘটেছে সেক্ষেত্রে বিবেকানন্দ—’a living fountain of inspira-tion’ (বলেছেন যদুনাথ সরকার)।

কিন্তু কেন? কী ধাতুতে তিনি গড়া? কী ছিল তাঁর জীবন-বেদের মর্মবাণী? কোথায় তার জীবন-জাহ্নবীর উৎসমুখ? তার আধ্যাত্মিকতা ও কর্মপ্রয়াস, দেশপ্রেম ও বিশ্বপ্রেম কী পরস্পর বিরােধী? তিনি কী শুধুই অপরাপর ধর্মীয় নেতাদের মতাে কোনাে ব্যক্তি সীমায় সীমিত? না সর্বসীমার অতীত কোনাে অখণ্ড জীবনবেদ? বর্তমানে তার চিকাগাে বক্তৃতার মূল্যায়ন করতে গেলে, উপরিউক্ত প্রশ্নের সন্ধান পেতে হলে বিবেকানন্দের জীবনগীতায় তার সন্ধান নিতে হবে।

চিকাগাে ভাষণ ও স্বামীজি :

এবার চিকাগাে ভাষণের কথায় আসা যাক। ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দের ১১ই সেপ্টেম্বর, সােমবার অপরাহে আমেরিকার চিকাগাে ধর্মমহাসভায় প্রথম দিনের অধিবেশনে, অধিবেশনের সভাপতি কার্ডিন্যাল গিবন শ্রোতৃবৃন্দের সঙ্গে স্বামীজির পরিচয় করিয়ে দেবার পর স্বামীজি অভ্যর্থনার উত্তর দিতে গিয়ে যে বক্তব্য রাখেন তার প্রথমদিকের কিছু অংশ উদ্ধৃত করা যেতে পারে—“হে আমেরিকাবাসী বােন এবং ভাইয়েরা, আমাদের প্রতি আপনারা যে উয় এবং সৌজন্যমূলক সম্বর্ধনা জানিয়েছেন তার উত্তর দিতে উঠে এক অবর্ণনীয় আনন্দে আমার হৃদয় ভরে যাচ্ছে।” এই উদ্বোধনী ভাষণের মূল বক্তব্য ছিল—সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা এবং তার ভয়াবহ উত্তরপুরুষ ধর্মোন্মত্ততা- সুন্দর এই পৃথিবীকে বহুদিন ধরে অধিকার করে রেখেছে তা অচিরেই ধ্বংস হবে—এই আশা রেখে।

বিভিন্ন ভাষণের মূল বক্তব্য :

দ্বিতীয় ভাষণ ঃ ১৫ই সেপ্টেম্বর, বিষয়—কেন আমরা অসম্মত (কুয়াের ব্যাঙের গল্পের মাধ্যমে—ধর্মীয় সঙ্কীর্ণতা দূর করা)।

তৃতীয় ভাষণ ঃ ১৯শে সেপ্টেম্বর ; বিষয় হিন্দুধর্ম প্রসঙ্গে; মূলবক্তব্য—ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিভিন্ন ধর্মের মূল্যায়ন।

চতুর্থ ভাষণ ঃ ২০শে সেপ্টেম্বর, বিষয়—ধর্ম ভারতের জরুরি প্রয়ােজন নয় ; মূল বক্তব্য ও খ্রিস্টানদের পৌত্তলিকতা।

পঞম ভাষণ ঃ ২৬শে সেপ্টেম্বর, বিষয়—বৌদ্ধধর্ম, হিন্দুধর্মের পূর্ণতা, মূল বক্তব্য—বৌদ্ধ ও হিন্দুধর্মের পারস্পরিক সম্পর্ক এবং হিন্দুধর্মের আনুষ্ঠানিক ও আধ্যাত্মিক দিক।

শেষ অধিবেশন—২৭শে সেপ্টেম্বর, বিষয়ঃ ধর্ম সমন্বয়। এই ভাষণে তিনি আশা করেছেন—“অচিরেই প্রতিটি ধর্মের পতাকার উপরই লেখা হবে ও ঝগড়া নয়, বন্ধুত্ব; বিনাশ নয়, একে অপরের ভাবধারা গ্রহণ; মতভেদ নয়, সমন্বয় ও শান্তি।”

ভাষণের প্রেক্ষাপট ও তাৎপর্য :

স্বামীজির চিকাগাে ভাষণের প্রেক্ষাপট তুলে ধরলে সেই পরিপ্রেক্ষিতে বিবেকানন্দের উদ্দিষ্ট ভাষণের তাৎপর্য সহজে উপলব্ধ হবে। স্বামীজি চিকাগাে যাওয়ার আগে সারা ভারত পরিক্রমা করে ভারতবর্ষের প্রাণস্পন্দনকে, তার শাশ্বত বাণীকে উপলব্ধি করেছিলেন।

তিনি সেদিন লক্ষ করেছিলেন— ঐতিহ্যচ্যুত ভারত পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুকরণে মত্ত, তামসিকতা, অনাচার ও কুসংস্কারের অক্টোপাশে লক্ষ লক্ষ বুভুক্ষু নরনারীর আর্তনাদ।

আর সেইজন্যই তিনি চিকাগােতে ২০শে সেপ্টেম্বরের ভাষণে বললেন—“প্রাচ্যের জরুরি অভাব ধর্ম নয়, তাদের যথেষ্ট ধর্ম আছে, অভাব হচ্ছে রুটির, যার জন্য ভারতবর্ষের লক্ষ লক্ষ দুর্দশাগ্রস্ত মানুষ শুকনাে গলায় কাঁদছে।

তারা আমাদের কাছে রুটি চাইছে কিন্তু আমরা তাদের দিকে পাথর ছুঁড়ছি। অনাহারক্লিষ্ট মানুষকে ধর্মদান করার অর্থ তাকে অপমান করা।”

শুধু তাই নয়, তিনি পরবর্তীকালে স্বীকার করেছেন—“যে ঈশ্বর ইহলােকে আমাকে রুটি দিতে পারে না, আমি বিশ্বাস করি না যে পরকালে তিনি আমাকে রুটি দেবেন।”

স্বামীজির চিন্তা ধারার প্রাসঙ্গিকতা :

স্বামীজি লক্ষ করেছিলেন—পিছিয়ে পড়া জাতি, অনুন্নত অর্থনীতি, জাতি সম্প্রদায়ের সংঘাত, ধর্মের নামে আচার-সর্বস্ব গোঁড়ামি, শােষণ ও অত্যাচার, মানুষের মনুষ্যত্বকে ভূলুণ্ঠিত করছে।

তাই ১৯শে সেপ্টেম্বরের চিকাগাে ভাষণে তিনি জানালেন—“হে সিংহশাবকরা, জাগ্রত হােন এবং আপনারা যে মেষশাবক এই ভ্রান্তি মন থেকে দূর করে দিন। আপনারা অবিনশ্বর আত্মা, মুক্ত আত্মা, পবিত্র এবং শাশ্বত।”

তিনি এই ভেবে আতঙ্কিত হয়েছিলেন যে ধর্ম সেদিন ভাতের হাঁড়িতে উঠেছে। তাই এই ভাষণে ধর্ম অর্থে মানুষের অন্তর্নিহিত দেবত্বের বিকাশকে বােঝালেন। ধর্মের কোনাে দেশকালের সীমানা নেই।

বিবেকানন্দের ধর্ম সম্বন্ধে এই দৃষ্টিভঙ্গি বর্তমান দিনের সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদের ক্ষেত্র কতখানি প্রযােজ্য তা বলে নিশ্চয় বােঝাতে হবে না।

বর্তমান সময় ও বিবেকানন্দের চিন্তাধারা :

অথচ আজকের পৃথিবী তথা ভারতবর্যের দিকে তাকালে ধর্মান্ধতা, দ্বেষ, হিংসা, মারামারি যেন নিত্য জীবনের রােজনামচা। সাধারণ মানুষ আজ অশিক্ষা, কুশিক্ষার অন্ধকারে নিমজ্জমান।

রাজনৈতিক, সামাজিক, আধ্যাত্মিক, সাংস্কৃতিক প্রতিটি স্তরে চালাকির অনুপ্রবেশ, শােষণের নতুন কায়দা, ইজমের কচকচির অবকাশে অশিক্ষার নিঃশব্দ প্রবেশ। রােগ ছড়িয়ে পড়েছে সর্বাঙ্গে, শুধু কথা আর কথার ফুলঝুরি।

আমাদের যুবসমাজের নৈতিক চরিত্র অধঃপতিত, চিন্তা ও ভাবের জগতে তারা দেউলিয়া, নৈরাজ্যের ক্লেদাক্ত দরজায় বসে তারা হতাশার গগনচুম্বী পাঁচিলে মাথা কুটে মরছে, নিঃসঙ্গতা ও বিচ্ছিন্নতার যন্ত্রণায় বেছে নিচ্ছে ড্রাগের মতাে ভয়ংকরী নেশাকে।

অথচ স্বামী বিবেকানন্দের চিকাগাে ভাষণের তথা তার আদর্শ অনুধ্যানের কথা বলা হচ্ছে। এ কি চালাকি? অথচ চালাকির দ্বারা মহৎ কর্ম হয় না—তা সবাই ভুলে গেছে।

শ্রীরামকৃয়ের কাছে বিবেকানন্দ যখন সমাধি চেয়েছিলেন তখন তাকে তিরস্কার করে বলেছিলেন—‘তাের চৈতন্য হাে৷ সেজন্যই তিনি শিবজ্ঞানে জীবসেবার ব্রতে ব্রতী হয়েছিলেন, ভারত পরিক্রমা করে সাধারণ মানুষের অভাব-অভিযােগ উপলব্ধি করেছিলেন এবং এই সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের সংগৃহীত অর্থে ভারতবর্ষের প্রতিনিধি হয়ে অনাহূত সন্ন্যাসী গিয়েছিলেন চিকাগাে ধর্মসভায় বক্তৃতা দিতে, ভারতবর্ষের মর্মবাণীকে তুলে ধরতে এবং সেদিনের ভারতবর্ষকে জগৎ সভায় আসন দিতে।

আজ ভারতবর্ষে সেইসব সমস্যা নতুন রূপে এসেছে আমাদের কাছে। তাই স্বামীজিকে নিয়ে শুধুমাত্র উৎসব অনুষ্ঠান না করে তার ইতিবাচক মনােভাবকে আমাদের গ্রহণ করতে হবে।

ছড়িয়ে দিতে হবে তার চিন্তা ও চেতনাকে, অনুপ্রেরণা নিতে হবে আমাদের। বর্তমানে আমাদের রাজ্যে সরকার স্কুলগুলিতে এ বিষয়ে আলােচনা সভা, বক্তৃতা প্রভৃতির মাধ্যমে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে স্বামীজির দর্শন ও চিন্তাভাবনাকে ছড়িয়ে দেবার প্রয়াস করেছেন।

উপসংহার :

জীবনানন্দ বলেছিলেন—পৃথিবীর গভীরতর অসুখ এখন। ক্লান্তি, হতাশাবােধ মানুষকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যাচ্ছে। এ থেকে মুক্তির পথ—আত্মবিশ্বাসে জাতিকে বলীয়ান হওয়া, মনুষ্যত্ববােধে উদ্দীপ্ত হওয়া, প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহার, যােগ্যতাকে বাড়ানাের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের চারিত্রিক সম্পদ (character resource)-কে বাড়ানাে, নিজেদের মুখ আয়নায় দেখে কলুষমুক্ত হওয়া, হারিয়ে যাওয়া চাবিকাঠির সন্ধান করা, ধর্মান্ধতা ত্যাগ করে তার আদর্শ ও মর্মবাণী যে সমন্বয়ের পথ তাকে গ্রহণ করা। তা না হলে, মেরুদণ্ডহীন জাতির বিবেকানন্দ স্মরণের কোনাে অবশেষ আর থাকবে না, মস্তক নত হবে বিশ্বের কাছে। শুধু হুজুগে মেতে উঠে নয়, স্বামীজির দৃষ্টিভঙ্গিকে উপলব্দি করে বর্তমান সময়ে তার প্রয়ােগকে গুরুত্ব দিতে হবে সর্বাগ্রে।


[su_posts template=”templates/list-loop.php” posts_per_page=”3″ tax_term=”1392″ order=”desc” orderby=”rand”]