সার্ধ জন্মশতবর্ষে জাতির জনক মহাত্মা গান্ধী

[su_posts template=”templates/list-loop.php” posts_per_page=”2″ tax_term=”1392″ order=”desc” orderby=”rand”]

সার্ধ জন্মশতবর্ষে জাতির জনক মহাত্মা গান্ধী

ভূমিকা :

জাতির জনক মােহনদাস করমচাঁদ গান্ধী ছিলেন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের পুরােধা ব্যক্তিত্ব। অথচ বর্তমান প্রজন্মের কাছে তিনি বিস্মৃতিতে হারিয়ে যাচ্ছেন। তার সত্যাগ্রহ আন্দোলনের মাধ্যমে ইংরেজের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে জনসাধারণের অবাধ্যতা প্রমাণিত হয়েছিল—যা অহিংস মতবাদের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল।

এই আন্দোলনের উপর ভিত্তি করে শুধু ভারতবর্ষে নয়, সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে মানুষের স্বাধীনতা ও অধিকার পাওয়ার আন্দোলন। তাঁর জন্ম সার্ধশতবর্ষে তাই ভারতীয়দের মতাে অন্য স্বাধীনতাকামী মানুষেরাও তার অহিংসা নীতি ও সত্যাগ্রহ আন্দোলনকে স্মরণ করবে।

জন্ম ও শিক্ষা :

১৮৬৯ সালের ২রা অক্টোবর পােরবন্দরে হিন্দু পরিবারে মােহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর জন্ম। তাঁর পিতা করমচাঁদ গান্ধী ছিলেন পােরবন্দরের দেওয়ান, মা পুতলিবা ছিলেন ধর্মমতে বৈষব।

ধার্মিক মায়ের সাথে এবং গুজরাটের জৈন প্রভাবিত পরিবেশে থেকে ছোটবেলা থেকেই জীবের প্রতি অহিংসা, নিরামিষ ভােজন, আত্মশুদ্ধির জন্য উপবাসে থাকা, বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী ও সম্প্রদায়ের পারস্পরিক সহিয়ুতা ইত্যাদি শিখতে শুরু করেন।

মাত্র তের বছর বয়সে কস্তুরবা মাখাঞ্জীকে বিয়ে করেন এবং তাদের চার সন্তান জন্মে। ১৮ বছর বয়সে ১৮৮৮ সালে ব্যারিস্টারি পড়ার জন্য লন্ডনে যান এবং তিনি ওখানেও নিরামিষ ভােজন করতেন।

দক্ষিণ আফ্রিকায় আন্দোলন :

জীবনাদর্শে গান্ধী অহিংস ছিলেন বলেই সেই মতাদর্শকে আন্দোলনের ক্ষেত্রে প্রথম প্রয়ােগ করেন দক্ষিণ আফ্রিকায় নিপীড়িত ভারতীয় সম্প্রদায়ের নাগরিকদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে (১৮৯৩-১৯১৪)।

দক্ষিণ আফ্রিকায় ভারতীয়দের বিরুদ্ধে বর্ণবাদ, কুসংস্কার এবং অবিচার লক্ষ করে গান্ধী তার জনগণের মর্যাদা ও অবস্থান নিয়ে আন্দোলনে সামিল হন ও নাটাল ইণ্ডিয়ান কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা করে প্রবাসী ভারতীয়দের রাজনৈতিকভাবে সংঘবদ্ধ করেন।

তাতে শান্তিকামী ভারতীয়দের উপর নিপীড়নমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করলে আন্দোলন আরাে দৃঢ় হয়। শেষপর্যন্ত আফ্রিকার জেনারেল ইয়ান ক্রিশ্চিয়ান স্মাট গান্ধীর সঙ্গে সমঝােতা করতে বাধ্য হন ও সত্যাগ্রহ আন্দোলন মর্যাদা পায়।

ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন :

ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ হয়ে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভায় বক্তৃতা করেন এবং গােপালকৃষ্ণ গােখেলের মাধ্যমে ভারতীয় জনগণের সাথে পরিচিত হন। জাতীয় আন্দোলনে তার প্রথম স্বীকৃতি আসে ১৯১৮ সালে চম্পারন বিক্ষোভ ও খেদা সত্যাগ্রহের মাধ্যমে।

ইংরেজরা গ্রামগুলিকে অতিরিক্ত নােংরা রাখা ও অন্যান্য কারণে শােষণের পথকে দৃঢ়তর করলে দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি হয়। গান্ধী একটি আশ্রম প্রতিষ্ঠা করে বহু স্বেচ্ছাসেবককে এ বিষয়ে একত্রিত করেন ও গ্রামবাসীদের সামগ্রিক পরিস্থিতির নকশা রচনা করেন।

এরপর আন্দোলন শক্তিশালী হলে জমিদারদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ সংগঠিত হলে ব্রিটিশ সরকার রাজস্ব হার বৃদ্ধি বন্ধ করেন ও ক্ষতিপূরণ প্রদানে স্বীকৃত হয়।

খেদায় ব্রিটিশদের সাথে সমঝােতার সময় কৃষকদের প্রতিনিধিত্ব করেন সর্দার প্যাটেল। গান্ধী বন্দীদের মুক্তি ও অতিরিক্ত রাজস্ব আদায় বন্ধ করার ব্যবস্থা করলে ঐসময় গান্ধীকে বাপু (পিতা) ও ‘মহাত্মা’ নামে জনগণ ডাকতে শুরু করে।

অসহযােগ :

পাঞ্জাবের জালিয়ানবাগ হত্যাকাণ্ডের পর গান্ধী ব্রিটিশদের কার্যাবলী ও ভারতীয়দের প্রতিশােধপরায়ণতার নিন্দা করেন। এই হত্যাকাণ্ড এবং জনবিক্ষোভের পর গান্ধী পূর্ণাঙ্গ স্বায়ত্তশাসন এবং সমস্ত সরকারি প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ লাভের দিকে মনােনিবেশ করেন যা শেষ পর্যন্ত ‘স্বরাজ’ বা সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত, আদর্শগত, রাজনৈতিক স্বাধীনতার আন্দোলনের রূপ নেয়।

১৯২১-এর ডিসেম্বর মাসে মহাত্মা ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের নির্বাহী দায়িত্বপ্রাপ্ত হন ও ব্রিটিশ পণ্য বর্জন-এর কর্মসূচি গ্রহণ করেন। এমনকি স্বাবলম্বনের জন্য ভারতীয়দের খাদির চাকা ঘুরানাের কথা বলেন। চৌরিচৌরায় তীব্র সংঘর্ষ শুরু হলে অসহযােগ আন্দোলন তীব্রতা পায়।

স্বরাজ ও লবণ সত্যাগ্রহ :

স্বরাজ পার্টি ও ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের মধ্যে বিভেদ দূর করে অস্পৃশ্যতা, মদ্যপান, অবজ্ঞা এবং দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম অব্যাহত রাখেন।

১৯৩০ সালে গান্ধী লবণের উপর কর আরােপের বিরুদ্ধে নতুন সত্যাগ্রহ আন্দোলন শুরু করেন এবং ডান্ডির উদ্দেশ্যে লবণ হাঁটা আয়ােজন করেন ও ৪০০ কি.মি. হেঁটে এলাহাবাদ থেকে ডান্ডিতে পৌছান নিজের হাতে লবণ তৈরির জন্য।

এর বদলা নিতে ব্রিটিশ সরকার ৬০,০০০ ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে। এরপরেই গাধী-আরউইন চুক্তি পাশ হয়। সেইসঙ্গে অস্পৃশ্যদের জীবনযাত্রার উন্নয়নে ২১ দিনের আত্মশুদ্ধি অনশন করেন।

গান্ধীর মূল নীতি :

গান্ধী নিজের জীবনকে সত্যানুসন্ধানের বৃহৎ উদ্দেশ্যে নিয়োজিত করেছিলেন। সেজন্য তিনি তার আত্মজীবনীর নাম দিয়েছিলেন ‘দ্য স্টোরি অফ মাই এক্সপেরিমেন্টস উইথ টুথ’। সত্যের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল তার অহিংস নীতি, ব্রম্মচর্য, নিরামিষ ভােজন, বিশ্বাস, সরলতা ও সাধারণ মানের জীবনচর্যা।

তার কাছে ব্ৰয়চর্য আসলে চিন্তা, কাব্য ও কর্মের নিয়ন্ত্রণ। তিনি মনে করতেন সামাজিক কাজে নিযুক্ত ব্যক্তি অপ্রয়ােজনীয় খরচ কমিয়ে সাদামাটা জীবন যাপন করবে। তিনি ছিলেন ভারতীয় সমাজে সৌভ্রাতৃত্বপূর্ণ সহাবস্থানের প্রবক্তা।

সৃষ্টিশীলতা :

গান্ধী ছিলেন বহুমখী লেখক ও সম্পাদক। তিনি সম্পাদনা করেছেন গুজরাটি, হিন্দি ও ইংরেজি ভাষায় ‘হরিজন’ পত্রিকা। প্রকাশ করেছেন ‘ইন্ডিয়ান অপিনিয়ন’ ও ‘ইয়ং ইন্ডিয়া। তাঁর রচিত গ্রন্থ হলঃ The story of My Experiments with Truth’, ‘Satyagraha in South Africa’, ‘Hind Swaraj or Indian Home Rule’, ‘Unto this last।

১৯৬০ সালে ভারত সরকার গান্ধীর রচনাবলী প্রকাশ করেন। অনেক রাজনৈতিক নেতা গান্ধীর দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন—যেমন, নেলসন ম্যান্ডেলা, খান আবদুল গফফর খান, স্টিফ বিকো, অং সান সু চী প্রভৃতি।

উপসংহার :

গান্ধী ভারতে ‘মহাত্মা’ ও ‘বাপুজী’ নামে খ্যাত হয়ে রয়েছেন এবং ভারত সরকার সরকারিভাবে তাঁকে জাতির জনক’ আখ্যা দিয়েছেন। ২রা অক্টোবর তার জন্মদিন ভারতে গান্ধী জয়ন্তী হিসেবে পালিত হয় এবং জাতিসংঘ ঐদিনকে আন্তর্জাতিক অহিংস দিবস’ রূপে ঘােষণা করেছে। তার বুনিয়াদী শিক্ষা, স্বয়ম্ভরতার জন্য আশ্রম প্রতিষ্ঠা, অস্পৃশ্যদের জন্য তাঁর আন্দোলন তথা অহিংস আন্দোলন এবং তার বিচিত্র কর্মপ্রয়াস আজও সাধারণ মানুষের কাছে আদর্শ হয়ে রয়েছে।


[su_posts template=”templates/list-loop.php” posts_per_page=”2″ tax_term=”1392″ order=”desc” orderby=”rand”]