বিজ্ঞান পাঠ ও বিজ্ঞানমনস্কতা

বিজ্ঞান পাঠ ও বিজ্ঞানমনস্কতা

ভূমিকা :

বিজ্ঞান পাঠ ও বিজ্ঞানমনস্কতার অভাবে কুসংস্কার বদ্ধমূল হয়। কুসংস্কার অযৌক্তিক অবৈজ্ঞানিক মানসিকতার প্রকাশ, আধুনিক যুক্তিবাদী প্রগতিশীল মনন ও জীবনের প্রতিকূল। সংস্কারের অর্থ যখন শুদ্ধি বা শােধন না হয়ে ভ্রান্ত অন্যায় বা কদর্য ধারণা, রীতি অথবা ধর্মবিশ্বাস রূপে পরিগণিত হয় তখন তা সংস্কার না হয়ে হয় কুসংস্কার বা Superstition।

অন্যদিকে বিজ্ঞানের সত্য হল যুক্তিতর্কের মাধ্যমে কার্যকারণ পরম্পরায় প্রমাণিত সত্য। এই সত্যে বিশ্বাসী হলেই মানুষ হয়ে ওঠে বিজ্ঞানমনস্ক। যুক্তির কষ্টিপাথরে যাচাই করে গড়ে ওঠে মানুষের বিজ্ঞানচেতনা। কিন্তু আধুনিক মানুষ সেই চেতনা থেকে বিচ্যুত হয়ে ক্রমে অন্ধ ধ্যানধারণা, অলৌকিক কার্যে বিশ্বাসী হয়ে উঠেছে।

বিজ্ঞান ও জীবন :

মানবসভ্যতার অগ্রগতিতে বিজ্ঞানের অবদান আজ সর্বজনস্বীকৃত। মানুষের সভ্যতার এই চরম সমুন্নতির মূলে রয়েছে বিজ্ঞানের অপরিসীম বিস্ময়। প্রাগৈতিহাসিক মানুষের আগুন আবিষ্কারের সময় থেকে আধুনিক যুগ পর্যন্ত মানুষের অতন্দ্র সাধনা বিজ্ঞানকে করে তুলেছে সমৃদ্ধ।

সকালে ঘুম থেকে উঠে রাতে শুতে যাওয়া পর্যন্ত বিজ্ঞান মানুষের অত্যন্ত অনুগত অনুচর। কৃষি, শিল্প, শিক্ষা, সংস্কৃতি, খেলাধুলা, চিকিৎসা, পরিবহন, যােগাযােগ—জীবনের প্রতি ক্ষেত্রে প্রতি পদক্ষেপে বিজ্ঞানের অবিস্মরণীয় অবদান। বিজ্ঞানের নিত্যনতুন আবিষ্কার মানুষকে করে তুলেছে কৌতূহলী।

বিজ্ঞানের আবিষ্কারের সুফল সাধারণ মানুষের কাছেও পৌঁছে যাচ্ছে। বিভিন্ন বিজ্ঞান সংস্থা, বিজ্ঞান মঞ্চ প্রচারের মাধ্যমে বিজ্ঞানকে জনমুখী করার উদ্যোগও গ্রহণ করেছে। সুতরাং বিজ্ঞানের সঙ্গে জীবনের যােগ অচ্ছেদ্য। বিজ্ঞান পাঠ করলে এই বােধ জাগ্রত হবে।

বিজ্ঞানের জয়যাত্রা :

“মহাবিশ্বে মহাকাশে মহাকাল মাঝে/আমি মানব একাকী ভ্রমি বিস্ময়ে।” -একথা বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সত্যিই তাে, মহাবিশ্বের রহস্য মােচনে, বিস্মিত মানুষের চিরন্তন ছায়াসঙ্গী বিজ্ঞান। বিজ্ঞানের আলােকে মানুষ শিখেছে। ভয়কে জয় করতে। বিশ্লেষণী মনের জ্ঞানের আলােকে খুঁজে চলেছে মহাজাগতিক ও জাগতিক রহস্যের ব্যাখ্যা।

কিন্তু কিছু স্বার্থান্বেষী ক্ষমতালােভী চিরকালই বিজ্ঞানের গলা টিপে মারতে চেয়েছে। মারতে চেয়েছে সক্রেটিস, গ্যালিলিও, আর্কিমিডিস-কে। কোন কোন ক্ষেত্রে তারা হয়েছে সফল, কিন্তু সামগ্রিকভাবে তারা ব্যর্থ। তাই আজও বিজ্ঞানের জয়যাত্রা রয়েছে অব্যাহত। এইসব আধুনিক মানুষের কাছে বিজ্ঞানকে তুলে ধরতে হবে তার পাঠ ও চর্চার দ্বারা। তাহলেই বিজ্ঞানমনস্কতা বাড়বে ও সংস্কার দূর হবে।

বিজ্ঞানমনস্কতা :

আধুনিক মানুষের প্রধান বৈশিষ্ট্য হল যুক্তিপ্রধান মনােভাব। এই যুক্তি চিন্তায় ও চেতনায়। বলাবাহুল্য, যখন একজন মানুষ চিন্তা ও চেতনায় যুক্তিবাদী হয়ে ওঠে তখন সে দৃষ্টি- ভঙ্গিতে হয়ে ওঠে বিজ্ঞানমনস্ক। আর একজন বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ কখনাে কুসংস্কারে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে না।

কেননা বিজ্ঞানমনস্কতার প্রধান বৈশিষ্ট্য হল ব্যবহারিক জীবনে যুক্তিপ্রবণ হওয়া আর ব্যবহারিক জীবনে কেউ যুক্তিবাদী হলেই সে বিজ্ঞানমনস্ক হয়ে ওঠে। বিজ্ঞানমনস্ক ব্যক্তির কাছে কুসংস্কারের অন্ধকার দূরীভূত হয়, ভ্রান্ত ধারণার খােলস খসে যায়।

তখন বাস্তব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে কার্যকারণ যােগসূত্রের জ্ঞান আর সত্য-মিথ্যা যাচাই-এর প্রক্রিয়ায় প্রকাশিত হয় সত্যের স্বরূপ। তখন প্রচলিত প্রথা-প্রকরণের অসারত্ব ধরা পড়ে যায় আর ঘুচে যায় কুসংস্কারের যুক্তিহীন দাসত্ব।

বিজ্ঞানমনস্ক হতে না পারার কারণ :

আজও আমরা যুক্তিবাদী তথা বিজ্ঞানমনস্ক হতে পারিনি। বিজ্ঞানের অগ্রগতির যুগেও মানুষের মন বলিষ্ঠ হতে পারেনি, হতে পারেনি আত্মবিশ্বাসে ভরপুর। তাই মানুষের ভীরু মন প্রচলিত বিশ্বাস ও নীতি-নিয়মকে মেনে নিচ্ছে, মিথ্যা ধর্মবােধকে আঁকড়ে ধরে লৌকিক আচারকে মেনে নিচ্ছে, যুক্তি দিয়ে সবকিছুকে যাচাই করবার মানসিকতা হারিয়ে ফেলছে।

দ্বিতীয়ত, আধুনিক মানুষ আজ ভাবের ঘরে চুরি করছে, আত্মপ্রবঞ্চনা, আত্মপ্রতারণা থেকে সে রেহাই পাবে কি করে? সেজন্য প্রয়ােজনে কোন একটা ভ্রান্ত বিশ্বাসকে আঁকড়ে ধরছে। সত্যি বলতে কি, আমাদের আত্মবিশ্বাসে আজ ভাটার টান, যার জন্য অলৌকিকতার ম্যাজিকের প্রতি এত বিশ্বাস।

তারকেশ্বরে ঘড়ায় করে জল দিতে যাওয়ার সময় যুবকদের যে আনন্দ তা তাে তাদের স্ব স্ব কর্মস্থলে দেখা যায় না, আসলে মানুষ যখন আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলে, কর্মের প্রতি যখন নিষ্ঠা লুপ্ত হয়ে যায়, নীতিবােধ সরে গিয়ে তখন সে বিবেকহীন হয়, ধর্ম যখন ভাতের হাঁড়িতে ওঠে—তখন তাকে পেয়ে বসে ‘পুলিশের দারােগা থেকে ম্যালেরিয়ার মশা’ পর্যন্ত। সেজন্যই তাে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন—“বুদ্ধির ভীরুতাই হল শক্তিহীনতার প্রধান আড্ডা।

করণীয় :

বিজ্ঞানচেতনার প্রসারে পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চ ও অন্যান্য স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ছাত্রছাত্রীদেরও সদর্থক ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে। তাদেরকে তাদের চারপাশে কোনাে কুসংস্কার দেখলেই, মানুষকে সে বিষয়ে সচেতন করতে হবে। এজন্য সরকার ও প্রশাসনকেও বিজ্ঞানের মাধ্যমে ইতিবাচক ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে।

উপসংহার :

প্রশাসনের গদাই-লস্করী চালের থেকেও বড় মানুষের বিজ্ঞান চেতনার অভাব, অভাব সৎ সাহসের। পুঁথিগত শিক্ষায় শুধু নয়, মানসিক শিক্ষাই হবে সংগ্রামের দিশারী। প্রভূত বিজ্ঞানচর্চা ও পাঠের ফলে মানুষের মধ্যে গড়ে উঠবে বিজ্ঞানমনস্কতা।

স্বামী বিবেকানন্দের মতে—মানুষের অন্তর্নিহিত সত্তার পূর্ণ বিকাশই হল শিক্ষা। নিজের মনের এই অন্তর্জানের আলােকে প্রজ্জ্বলিত করে যেদিন আমরা হাতে হাত মিলিয়ে দাঁড়িয়ে সগর্বে কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস, ভণ্ড স্বামীজি-গুরুজীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণা করব সেদিন থেকেই শুরু হবে আলাের জয়যাত্রা।

নতুন পৃথিবীকে নতুন সমৃদ্ধ জ্ঞানের আলােয় উদ্ভাসিত হতে দেখব আমরা। স্বর্গ খুঁজতে আর সেদিন মানুষকে ছুটতে হবে না। নেমে আসবে স্বর্গ এই ধরার বুকে আলাের দ্যোতনা নিয়ে। সেদিন আমরা গাইব—“আমার মুক্তির আলােয় আলােয়, এই আকাশে….’।

অনুসরণে লেখা যায় :

বিজ্ঞান শিক্ষা ও বিজ্ঞানমনস্কতা। [উ. মা, ২০০৭]

বিজ্ঞানচেতনার প্রসারে ছাত্রছাত্রীদের ভূমিকা।

                                        [উ. মা, ২০০০]

বিজ্ঞান ও বিজ্ঞান মানসিকতা। [মা. ১৯৯৯]


[su_posts template=”templates/list-loop.php” posts_per_page=”3″ tax_term=”1392″ order=”desc” orderby=”rand”]