১৭৫ তম জন্মবর্ষে নট নাট্যকার গিরিশচন্দ্র ঘােষ

[su_posts template=”templates/list-loop.php” posts_per_page=”3″ tax_term=”1392″ order=”desc” orderby=”rand”]

১৭৫ তম জন্মবর্ষে নট নাট্যকার গিরিশচন্দ্র ঘােষ

ভূমিকা :

রঙ্গালয়ে ত্রিশ বৎসর’ গ্রন্থে অপরেশ মুখােপাধ্যায় লিখেছেন, “গিরিশচন্দ্র এদেশের নাট্যশালার প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন মানে—তিনি অন্ন দ্বারা ইহার প্রাণ রক্ষা করিয়াছিলেন, বরাবর স্বাস্থ্যকর আহার দিয়া ইহাকে পরিপুষ্ট করিয়াছিলেন;

ইহার মজ্জায় মজ্জায় রসসার করিয়া ইহাকে আনন্দপূর্ণ করিয়া তুলিয়াছিলেন; আর এইজন্যই গিরিশচন্দ্র Father of the Native Stage ইহার খুড়াে জ্যাঠা আর কেহ কোনদিন ছিল না।

” নট, নাট্যকার, নাট্য পরিচালক ও সাধারণ রঙ্গালয়ের প্রতিষ্ঠাতা গিরিশচন্দ্রের ১৭৫তম জন্মবর্ষেও তার প্রতিভা ও কীর্তিকে আরাে বেশি করে উপলব্ধি ও স্মরণ করার প্রয়ােজন হয়ে পড়েছে।

কৃতিত্ব :

সাধারণ মানুষের জন্য নাটক রচনা করা, সাধারণ রঙ্গালয় প্রতিষ্ঠা, রঙ্গমঞ্চ পরিচালনা, অভিনয় শিল্পের শিক্ষাদানে এবং একটি নাট্যগােষ্ঠী তৈরির প্রচেষ্টার দিক থেকে গিরিশচন্দ্র ঘােষের মতাে কৃতিত্ব অন্য কোন নাট্যব্যক্তিত্বের মধ্যে লক্ষ করা যায় না।

গিরিশচন্দ্র জানতেন নাট্যরস প্রকাশের ভিত্তি রঙ্গমঞ্চ এবং সাধারণ মানুষের মর্মের মতাে করে কিভাবে নাটক রচনা করতে হয়। তাই তিনি বিভিন্ন শ্রেণির নাটক রচনা করে বাংলা নাট্যসাহিত্যের যেমন সমৃদ্ধিসাধন করেছেন তেমনি সাধারণ মানুষের নাট্যরস পিপাস চরিতার্থ করতে পেরেছেন।

মানস বৈশিষ্ট্য :

নাস্তিক গিরিশচন্দ্র শ্রীরামকৃয়ের সান্নিধ্যে এসে আস্তিক হয়ে ওঠেন এবং ভক্তিমূলক নাটক রচনায় কৃতিত্ব অর্জন করেন। দ্বিতীয়ত গিরিশচন্দ্রের শিক্ষা ও স্পর্শকাতর অভিমান বৃদ্ধি প্রথম থেকেই তাঁর মধ্যে এক গভীর জাতিপ্রীতির প্রেরণা জাগিয়ে দিয়েছিল।

ন্যাশনাল থিয়েটারের জন্মলগ্নে সেই মরে সঙ্গে গিরিশচন্দ্রের সম্পর্কছেদের ইতিহাস এ বিষয়ের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রমাণ। তৃতীয়ত, শুধু জাতিপ্রীতি নয়, জাতীয় মর্যাদা রক্ষার বিষয়ে গিরিশচন্দ্রের এই স্বেচ্ছাকৃত দায়িত্ববৃদ্ধি তার অন্তঃস্বভাবের পরিচয় বহন করে।

চতুর্থত, গিরিশচন্দ্রের নাট্যকৃতির বিস্ময়কর মও সাফল্যের কারণ শুধু উৎকৃষ্ট অভিনয় নৈপুণ্য নয়, দর্শকদের হৃদয়বৃত্তি ও মনােভাবকে উপলব্ধি করে তাকে নাট্যরূপ দেওয়া।

নাট্যপঞ্জী :

তাঁর নাট্যপঞ্জী বিষয়ানুসারে ছয়টি ভাগে বিভক্ত। (ক) গল্প, উপন্যাস ও কাব্যের নাট্যরূপ : কপালকুণ্ডলা’, ‘চোখের বালি’, যমালয়ে জীবন্ত মানুষ’ ইত্যাদি। (খ) গীতি- নাট্য : ‘অকালবােধন’, ‘আগমনী’, ‘স্বপ্নের ফুল’ ইত্যাদি।

(গ) ঐতিহাসিক নাটক ও ‘কালাপাহাড়’, ‘সাম’, ‘ সিরাজদ্দৌলা’, ছত্রপতি শিবাজী’ প্রভৃতি।

(ঘ) পৌরাণিক ও ভক্তিমূলক নাটক ও ‘অভিমন্যুবধ’, লক্ষ্মণ বর্জন’, ‘রামের বনবাস’ ‘সীতাহরণ’, ‘নল দয়মন্তী’, ‘চৈতন্যলীলা’, ‘বিল্বমঙ্গল’, ‘পাণ্ডবগৌরব’, ‘জনা’ইত্যাদি। (ঙ) সামাজিক ও পারিবারিক নাটক ঃ প্রফুল্ল’, হারানিধি’, বলিদান’ প্রভৃতি।

(চ) প্রহসনঃ ‘ভােটমঙ্গল’, ‘হীরার ফুল’, ‘বড়দিনের বকশিস’, ‘বেল্লিক বাজার’, সভ্যতার পাণ্ডা’, ‘য্যায়সা কা ত্যায়সা’, শাস্তি কি শান্তি ইত্যাদি।

নাট্যকার সত্তা :

নাট্যকার রূপে গিরিশচন্দ্রের জনপ্রিয়তা তাঁর পৌরাণিক নাটকে। পৌরাণিক পুনরুজ্জীবন ছিল তাঁর স্বপ্ন। তিনি বুঝেছিলেন, “ভারত ধর্মপ্রাণ, যাহারা লাঙ্গল ধরিয়া চৈত্রের রৌদ্রে হাল সঞ্চালন করিতেছে তাহারাও কৃয়নামে আকৃষ্ট।

যদি নাটকের সার্বজনিক হওয়া প্রয়ােজন হয়, তবে কৃয়নামেই হইবে। হিন্দুস্থানের মর্মে মর্মে ধর্ম। মর্মাশ্রয় করিয়া নাটক লিখিত হইলে ধর্মাশ্রয় করিতে হইবে।” বাঙালির এই অনির্বাণ ভক্তিপ্রবণতাকেই তিনি স্থাপিত করলেন পৌরাণিক নাটকে।

শ্রীরামকৃয়ের নিষ্কাম কর্ম, সর্ব ধর্ম সমন্বয় ও অদ্বৈতবাদের আদর্শ গিরিশচন্দ্রের পৌরাণিক নাটকের বিশেষ সম্পদ।

সামাজিক নাটক

গিরিশচন্দ্র সামাজিক নাটকে বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজের চিত্র অঙ্কন করেছেন। একান্নবর্তী পরিবারের চিত্র, সমাজসত্তার কাছে ব্যক্তিসত্তার পরাজয়, বিধবা বিবাহ, কন্যাদায়, পণপ্রথা, সম্পত্তি সংক্রান্ত গােলমাল প্রভৃতি ঘটনা তার সামাজিক নাটকে স্থান পেয়েছে।

প্রফুল্ল’ নাটকে একান্নবর্তী পরিবারের কর্তা যােগেশের কাহিনি এই নাটকের বিষয়। আবার পণপ্রথার বিষময় ফল বর্ণিত হয়েছে। ‘বলিদান’ নাটকে।

ঐতিহাসিক নাটক :

স্বদেশি আন্দোলনের উত্তাপে উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি বেশ কয়েকটি ঐতিহাসিক নাটক রচনা করেছিলেন। তিনি অবশ্য গঠনমূলক স্বাদেশিকতার পক্ষপাতী ছিলেন। জাতীয়তার বিকাশে স্বামীজির পথ ও আদর্শকে অনুসরণ করেছেন।

সিরাজ চরিত্রে তাই পরাধীনতার অন্তর্জালাকে প্রকাশ করেছেন। জন্মভূমিকে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করার জন্য সিরাজ সচেষ্ট হয়েছেন। হিন্দু-মুসলমানের ঐক্যচেতনাও তার ঐতিহাসিক নাটকে বর্তমান। এসেছে হিন্দু পুনরুজ্জীবনের কথাও।

কেন আজও স্মরণীয় :

(১) গিরিশচন্দ্র সর্বসাধারণের জন্য জাতীয় রঙ্গালয় প্রতিষ্ঠা করে সাধারণ মানুষের নাট্য পিপাসা চরিতার্থ করার ব্যবস্থা করেছেন।

(২) পরাধীন ভারতে নাটকে দেশীয় ভাব ও জাতীয়ভাবকে উদ্দীপ্ত করেছেন।

(৩) মর্মাশ্রয় করে নাটক রচনায় প্রয়াসী হয়েছেন।

(৪) গৈরিশ ছন্দের ব্যবহার করেছেন নাটকে।

(৫) সংলাপকে সাবলীল ও গতিশীল করে তুলেছেন।

(৬) তার চরিত্রগুলিও দর্শকদের কাছে আকর্ষণীয়।

(৭) মঞ্চের জন্য নাটক রচনায় প্রয়াসী হয়েছেন।

(৮) শুধু নাটক রচনা করে নয়, নাট্যাভিনয় ও নাট্য পরিচালনার মাধ্যমে তিনি বাংলার গ্যারিক’ অভিধায় ভূষিত হয়েছেন।

উপসংহার :

যে কোনাে কীর্তিমান এর জন্ম শতবর্ষে বা এ ধরনের কোনাে তাৎপর্যপূর্ণ সময় এলে আমরা বাঙালিরা নতুন করে তাদের কীর্তিকথা ও সৃষ্টিশীল সাহিত্যের আলােচনায় ব্রতী হই।

১৭৫তম জন্ম শতবর্ষে তাই গিরিশচন্দ্রের নাট্যসত্তার নতুন মূল্যায়ন হবে, বাংলার নাট্যরসিকেরা আবার নতুন করে গিরিশচন্দ্রের প্রতিভাকে স্মরণ করবে ও উঠে আসবে অনেক অজানা দিক।


[su_posts template=”templates/list-loop.php” posts_per_page=”3″ tax_term=”1392″ order=”desc” orderby=”rand”]