স্মরণে মননে কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী

স্মরণে মননে কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী

[su_posts template=”templates/list-loop.php” posts_per_page=”2″ tax_term=”1392″ order=”desc” orderby=”rand”]

ভূমিকা :

জগৎ ও জীবনের প্রতি নির্মোহ দৃষ্টিভঙ্গি এবং প্রবল আশাবাদ যাঁর কাব্যজীবনের অন্বিষ্ট সেই নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী পঁচানব্বই বছর বয়সে লােকান্তরিত হলেন। উলঙ্গ রাজা’-র কবি রেখে গেলেন তার অসাধারণ কাব্যকীর্তিকে।

কবিচিত্তের অনন্ত প্রশান্তি ও তার আন্তরিকতায় তাঁর কবিতাগুলি হয়ে উঠেছে আন্তরিক। সেই সহজ-সরল অকৃত্রিম ভঙ্গি আধুনিক কবিদের মধ্যে তাকে স্মরণীয় করে রাখবে।

জীবন ও শিক্ষা :

১৯২৪ সালের ১৯শে অক্টোবর বর্তমান বাংলাদেশের ফরিদপুর-এর চান্দ্রায় কবি নীরেন্দ্র চক্রবর্তীর জন্ম। কবি প্রথম থেকেই কলকাতার বাসিন্দা। বঙ্গবাসী কলেজ স্কুল, বঙ্গবাসী কলেজ ও সেন্ট পলস কলেজ থেকে তাঁর শিক্ষা।

তার পেশা ছিল সাংবাদিকতা। ১৯৪২ থেকেই তিনি কয়েকটি পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত হন। মাতৃভূমি’, ‘প্রত্যহ’, ‘ভারত’, ‘স্বরাজ পত্রিকা’, সত্যযুগ’, শ্রীহর্ষ’, কিশাের পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯৫১ থেকে ‘আনন্দবাজার পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি সাহিত্য আকাডেমি পুরস্কারও পেয়েছেন।

কাব্যগ্রন্থ :

তাঁর প্রকাশিত কাব্যসংকলনগুলির মধ্যে উল্লেখযােগ্য হল ঃ ‘নীল নির্জন’, ‘প্রথম নায়ক’, ‘অন্ধকার বারান্দা, নীরক্ত করবী’, কলকাতার যীশু, উলঙ্গ রাজা’, কবিতার বদলে কবিতা’, ‘আজ সকালে’, ‘ঘর-দুয়ার’, সময় বড় কম’, ‘জঙ্গলে এক উন্মাদিনী’, ‘চল্লিশের দিনগুলি’, ‘সত্য সেলুকাস’, ‘অন্য গােপাল’, ‘জলের জেলখানা থেকে’ ইত্যাদি।

কবিসত্তা :

তাঁর কবিতার প্রধান আশ্রয় মানুষ। মানুষের প্রেম, ভালােবাসা, আবেগ তাঁর কবিতায় ঠাই পেয়েছে। মানুষের তথা মানবতার অবমাননা তিনি সহ্য করতে পারেননি বলেই সেই অবমাননার বিরুদ্ধে তিনি কলম ধরেছেন।

তিনি সমস্ত ভণ্ডামির বিরুদ্ধে। তাই সমকালীন জীবনের ভণ্ডামি, শােষণ ও অবিচার তার কলমে ব্যঙ্গের রূপ নিয়েছে। আধুনিক সভ্যতার নেতিবাচক দিক, রাষ্ট্রব্যবস্থায় শাসকের ন্যায়নীতি ভ্রষ্টতা ও প্রজাশােষণ, বুদ্ধিজীবীদের স্তাবকতা ও বিবেকহীনতা প্রভৃতি তাঁর কবিতায় রূপ পেয়েছে।

আত্মসর্বস্ব আধুনিক সভ্যতার নির্লজ্জ রুপ দেখে ব্যথিত কবি একটি রূপকের ছলে প্রশ্ন করেছেন শাসক শক্তির কাছে, রাজা তাের কাপড় কোথায়?

কাব্য বৈশিষ্ট্য :

মানুষের কবি ও মানবতার পূজারী নীরেন্দ্রনাথ তাঁর কবিতায় মানুষকে দেখেছেন। অখণ্ড দৃষ্টিতে। মানুষের মধ্যেই কবি ঈশ্বরকে দেখেছেন, মানুষের সারল্যের মধ্যে ঈশ্বরের প্রকাশকে উপলব্ধি করেছেন।

তাই কলকাতার যীশু’ কবিতায় যীশুকে মানবতাবাদের মূর্ত প্রতীক হিসেবে উপস্থাপিত করেছেন—স্তব্ধ হয়ে সবাই দেখছে,/টালমাটাল পায়ে/রাস্তার একপার থেকে অন্যপারে হেঁটে চলে যায়। সম্পূর্ণ উলঙ্গ এক শিশু।

মানবতাকে উপস্থাপিত করতে গিয়ে কবি জীবনকে ভালােবেসেছেন—গভীর মমত্ববােধ দিয়ে। তাই আশ্রয়হীন পুঁটলি ঘাড়ে করে চলে যাওয়া মানুষটিকে কবি গৃহজীবনে আহ্বান জানান এভাবে-ও বড়াে বউ, ডাকো ওকে ডাকো/এই যে লােকটা পার হয়ে যায়/কাসাই নদীর সাঁকো।

তাঁর কবিতা প্রেরণাও মানুষ, তাই মানুষ ও কবিতা তার কাছে সমার্থক। তাই লিখেছেন,—স্পষ্ট কথাটিকে আজ অন্তত একবার খুব স্পষ্ট করে বলে দেওয়া ভাল।/অন্তত একবার আজ বলা ভাল,/যা-কিছু সামনে দেখছি ‘ধোঁয়া বা পাহাড় কিম্বা পরস্পর আলাপ নিরত/ক্ষিপ্র শিশু/হয়তাে তা ছাড়া কোনাে দৃশ্য নেই। সমকাল চেতনা কবির কাব্যে এসেছে বারেবারে।

যেমন, চিলের কান্নায় কবি উপলব্ধি করেছেন, অমন ধারালাে শুকনাে বুকফাটা আর্তনাদ আমি/কখনাে শুনিনি।/মনে হয়েছিল, যেন পাখি নয়, বিশ্ব চরাচর/আজ রাত্রে ওই/কলঘরে অন্ধকারে বন্দী হয়ে চিৎকার করছে।

মানুষের কাছে মানুষের জন্য প্রেম ও ভালােবাসা প্রত্যাশা করে লিখেছেন, মানুষ। তােমার প্রেম ছিল।/তবুও, মানুষ, তুমি কিছুই দিলে না/নিখিল সংসারে। কবি যখন সমকালীন জগত দেখে অসহায়তা অনুভব করেন তখন প্রাকৃতিক জগতে খুঁজে পান নির্মল আনন্দ—‘আকাশে গৈরিক আলাে।

হেমন্ত-দিনের মৃদু হাওয়া। কৌতুকে আঙুল রাখে ঘরের কপাটে,/জানালায়। পশ্চিমের মাঠে/মানুষের স্নিগ্ধ কণ্ঠ। তিনি মনে করতেন পৃথিবীতে একদিন সমস্ত প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম লুপ্ত হয়ে যাবে এবং মানুষের ধর্ম প্রতিষ্ঠিত হবে।

মা-মাটি-মানুষকে ভালােবেসে মানুষের প্রতি দৃঢ় আস্থা রেখে কবি উচ্চারণ করেন—“আজকে তুমি কৃপণ বড়,/দিচ্ছ না কিছুই,/তাই যেখানেই বাগান করাে,/ফুটছে না বেল-জুই,/উঠছে না গান তাই বাতাসেব,/আকাশ থমকে আছে,/হাত পেতেছি তাই আমি ফের। মানুষ তােমার কাছে।

কৃতিত্ব :

মানবতাবাদী কবি নীরেন চক্রবর্তী মানুষকে তার অসহায়তার বেদনা থেকে মুক্তি দিতে চেয়েছেন কবিতার মাধ্যমে। জগৎ ও জীবনে সমকালের প্রেক্ষিতকে সহজ ও স্বাভাবিকভাবে তুলে ধরেছেন।

কামনা করেছেন মানুষে মানুষে সম্পর্কের দৃঢ় বন্ধন—“অন্ধকারে আলাে দিতে হলে/আরও কিছু দিতে হয়/প্রেম দিতে হয়। সমকালীন সমাজের দ্বন্দ্বকে, মানুষের বিপন্নতাকে, অস্তিত্বের সংকটকে মেলে ধরতে চেয়েছেন কবি।

কবিতার কায়ানির্মাণেও তার কৃতিত্ব অবিসংবাদি। যেমন, উঠোন জুড়ে, আলপনা, আল-পথের পাশে/হিজল গাছে সবুজ গােটা,/পুণ্যি পুকুর, মাঘমণ্ডল, টিনের চালে হিমের ফোটা।

উপসংহার :

নীরেন চক্রবর্তী লােকান্তরিত হলেও তার দৃষ্টিভঙ্গি ও কবিতা শাশ্বত। জগৎ ও জীবন সম্পর্কে তাঁর উপলব্বি, আশাবাদ ও প্রতিবাদ সত্তা মানুষকে অনেকদিন উদ্বোধিত করবে এবং তার কবিতার ভাবের একমুখিনতা ও প্রকাশের সাবলীলতা কবিতার আস্বাদ্যমানতাকে তাৎপর্যমণ্ডিত করে রাখবে।


[su_posts template=”templates/list-loop.php” posts_per_page=”2″ order=”desc” orderby=”rand”]