সমাজ জীবনে টেলিভিশনের প্রভাব

সমাজ জীবনে টেলিভিশনের প্রভাব

ভূমিকা : 

মহাভারতে অন্ধরাজা ধৃতরাষ্ট্রকে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের ধারাবিবরণী দেবার জন্য সঞ্জয়ের একটি মহৎ ও বিচিত্র শক্তির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তিনি যুদ্ধক্ষেত্র থেকে দূরে থেকেও যুদ্ধের প্রত্যেকটি কাজ ও ঘটনা পরিষ্কারভাবে প্রত্যক্ষ করতে পারতেন। আধুনিক বিজ্ঞানে টেলিভিশন যন্ত্রের আবিষ্কারের ফলে সঞ্জয়ের এই বিশেষ ক্ষমতাকে কেবলমাত্র দৈব প্রভাব বা অলৌকিক ব্যাপার বলে মনে না করে আমরা নীতিগতভাবে তার সম্ভাব্যতাকেও স্বীকার করে নিতে পারি। আজ আধুনিক জীবনে দূরদর্শন দূরকে নিকট করেছে। টেলিভিশনের প্রভাব মিশ্র ফলাফল সূচিত করেছে, কোন কোন ক্ষেত্রে আবার তা অশুভ ফলদায়ক রূপে দেখা দিয়েছে।

টেলিভিশনের কার্যকারিতা : 

টেলিভিশন আজকের আধুনিক জীবনে শক্তিশালী প্রচারমাধ্যম। এমন কোন বিষয় নেই যা টেলিভিশনের আওতার বাইরে। সিনেমা, নাটক, কৃষিকথা, আইনি পরামর্শ, সাম্প্রতিক বিষয়, জ্ঞান-বিজ্ঞান, বিভিন্ন দেশ-বিদেশের সংবাদ, শিক্ষামূলক প্রভৃতি নানান ব্যাপারে সব শ্রেণির দর্শকদের উপযােগী বিষয় পরিবেশন করছে আজকের দূরদর্শন। এমনকি সাধারণ মানুষের অভাব-অভিযােগও সরাসরি উঠে আসছে দূরদর্শনে। তাছাড়া নির্বাচনের প্রাক্কালে জনমত গঠনের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের বক্তব্যও দূরদর্শনে প্রচারিত হয়। খেলাধুলার ক্ষেত্রেও দূরদর্শনের কার্যকারিতা যথেষ্ট। কেননা, সুদূর দক্ষিণ আফ্রিকায় ভারত যে একদিনের ম্যাচ খেলছে, তা সরাসরি দেখিয়ে ক্রীড়ামােদী মানুষদের আনন্দ দান করছে। সর্বোপরি চিত্ত বিনােদনের মাধ্যম হিসেবে দূরদর্শনের গুরুত্ব অপরিসীম।

বিনােদনের ক্ষেত্রে টেলিভিশন :

বিনােদনের ক্ষেত্রে টেলিভিশনের গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। দূরদর্শনের মতাে দৃশ্য ও শ্রাব্য মাধ্যম মানুষের মনকে বেশি আকৃষ্ট করে। এমনকি মানুষের নিঃসঙ্গতাকে দূর করতে এর জুড়ি মেলা ভার। তাই নিঃসঙ্গ মানুষের ক্ষেত্রে, কর্মক্লান্ত ব্যক্তির কাছে, সময় কাটাবার জন্য দূরদর্শনের গুরুত্ব অপরিসীম। বর্তমানে যেহেতু দূরদর্শনের চ্যানেল অসংখ্য এবং সারা দিনরাত তা চলতে থাকে তাই যে কোন মানুষ ইচ্ছা করলেই তার পছন্দ মতাে অনুষ্ঠান দূরদর্শনে পেয়ে যেতে পারেন—শুধু বােতাম টেপার অপেক্ষায়। অর্থাৎ একজন গৃহবধূ বিকেলের অফুরন্ত অবসর কাটাতে দূরদর্শনের সিরিয়ালকে বেছে নিতে পারে, একজন ছাত্র জ্ঞানলাভের জন্য বেছে নিতে পারে শিক্ষামূলক অনুষ্ঠানকে, একজন কৃষক দেখতে পারেন কৃষি-সম্পর্কিত অনুষ্ঠানকে, যারা নিছক বিনােদন পিয়াসী তারা বেছে নিতে পারেন বিনােদনমূলক যে কোন অনুষ্ঠানকে। আগে যেখানে দূরদর্শনের অনুষ্ঠান নগরকেন্দ্রিক ছিল, এখন সেখানে বিভিন্ন চ্যানেলের সৃষ্টি হওয়ার ফলে গ্রামজীবনের বহু খুঁটিনাটি দিক টেলিভিশনে উপস্থাপিত হচ্ছে।

সমাজ জীবনে টেলিভিশন :

সমাজ জীবনে টেলিভিশনের প্রভাব অপরিসীম। এমনও গ্রাম আছে, যেখানে বিদ্যুতের আলাে পৌঁছেনি, সেখানে ব্যাটারি কিংবা সৌরচালিত শক্তির সাহায্যে টেলিভিশনের ব্যবহার করছে সেখানকার মানুষ। বিশেষ করে টেলিভিশনে প্রচারিত সিনেমা ও নাটক, সেই সঙ্গে খেলা বিশেষ করে ফুটবল ও ক্রিকেট খেলা দেখার জন্য বহু মানুষ টেলিভিশনের সামনে ভিড় করে। এখন তাে আবার কেবল লাইনের কল্যাণে পছন্দমতাে যে কোন অনুষ্ঠান সারাদিন ও সারারাত্রি যখন খুশি দেখা যায়। শুধু চ্যানেল পরিবর্তন করলেই হল—যে যার পছন্দমতাে অনুষ্ঠান পেয়ে যেতে পারবেন, কোন অসুবিধা নেই। শিক্ষা, চিকিৎসা, আইন, রাজনীতি, যুক্তিতর্ক, রঙ্গব্যঙ্গ প্রভৃতি বিষয়গুলি টেলিভিশনের দর্শক সংখ্যাকে বৃদ্ধি করছে। বিশেষ করে নারী ও ছাত্রদের উপর টেলিভিশনের প্রভাব সমধিক।

নারী সমাজে টেলিভিশন :

নারীদের সচেতনতা বৃদ্ধিতে টেলিভিশনের ভূমিকা যথেষ্ট। নিঃসঙ্গ ও অবসরকালীন অবস্থায় টেলিভিশনের মতাে সঙ্গীকে বেছে নিয়েছে আজকের বেশিরভাগ নারী সমাজ। এর যেমন ভালাে দিক আছে তেমনি খারাপ দিকও আছে। ভালাে দিক হল—সময় কাটানাে ও আনন্দ পাওয়ার ক্ষেত্রে টেলিভিশনের তুলনা নেই। কিন্তু অশুভ দিকটিও সমান বিবেচ্য। কারণ আজকের শিশু, কিশােরী থেকে প্রৌঢ়া পর্যন্ত কেউই টেলিভিশনের প্রভাব থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। ফলে পােশাক-পরিচ্ছদ, আহার-বিহার, এমনকি মানসিক দৃষ্টিভঙ্গি পর্যন্ত টেলিভিশনের অনুষ্ঠানের অনুকরণে রূপায়িত হচ্ছে। ফলে সংস্কৃতির নিজ স্বরূপ হারিয়ে গিয়ে দেখা দিচ্ছে পরানুকরণ। এই ঐতিহ্য বিনাশকারী ও পরানুকরণকারী সংস্কৃতি মানুষের স্বাভাবিক উন্নতির অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। মুক্ত অর্থনীতির বাজারে সব রকম অনুষ্ঠানই কোন তদারক ব্যবস্থা ছাড়াই দর্শকদের সামনে চলে আসায় অর্ধ-শিক্ষিত ও অশিক্ষিত রমণীদের কাছে এই সব অনুষ্ঠান প্রভাব ফেলছে। বিশেষ করে রুপপালি পর্দার নায়ক-নায়িকা, কিংবা মডেলের অনুকরণে নারীরা নিজেদের সজ্জিত ও প্রকাশ করতে গিয়ে নিজেদের স্বাভাবিকতা জলাঞ্জলি দিচ্ছে। এমনকি নিঃসঙ্গতা কাটানাের জন্য বিভিন্ন টিভি সিরিয়ালগুলিও বিশেষ অশুভ প্রভাব ফেলছে, বইপড়ার প্রতি আকর্ষণ কমে যাচ্ছে। নারীর মনে নিয়ে আসছে বিভিন্ন সংস্কার ও দ্বন্দ্বের দোলা—যা তাদেরকে নেতিবাচক দিকে ঠেলে দিচ্ছে। তবে টেলিভিশনের ভালাে দিকের প্রভাব যে নেই তা নয়, কিন্তু খারাপ দিকটাই নারীসমাজকে বেশি প্রভাবিত করছে। এমনকি বিভিন্ন দূরদর্শনের প্রচারিত সিরিয়ালগুলি নারীর চাহিদা ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করছে। সিরিয়ালের চরিত্রের আদব কায়দা ও বিভিন্ন বিষয় বিচার না করেই তারা গ্রহণ করছে। ছাত্র সমাজে টেলিভিশন শুভ ও অশুভ দুই দিকই নিয়ে আসছে। অনেক ছাত্রছাত্রী টেলিভিশনের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে অকালে হারিয়ে যাচ্ছে। অনেক মানুষ এর ফলে হয়ে যাচ্ছেন অলস।

উপসংহার :

শুধু কি তাই, আজকের অভিভাবকরা নিজেদের ছেলের সামনে কোন অপরাধমূলক কাজ করতে দ্বিধা করেন না, তাই তারা কোনমুখে তার ছেলেমেয়েদের সাবধান করবেন, সজাগ করবেন? নিজের ছেলেকে তারা ‘হি-ম্যান’ বানাতে চান, বড় আহ্লাদে কিনে দেন খেলনা বন্দুক, কিনে দেন জঙ্গী পােশাক, যােগাড় করে দেন ‘কম্যান্ডাে স্টিকার। তাই আজকের ছাত্রসমাজের আদর্শ তার বাবা নয়, কোন মহাপুরুষ নয়-র্যাম্বো অথবা এই। জাতীয় কোন নব্য সংস্করণ। কোন এক সাংবাদিক তাই লিখেছেন—“বলটা তাই আপাতত অভিভাবকের কোর্টে। টিভির বন্ধনমুক্তিতে আপনি উল্লসিত? ঘরে। বসে দেখতে চান দারুণ সব অ্যাকশন, প্রাণভরে দেখুন, সপরিবারে। দেখুন। শুধু মনে রাখবেন ঐ অ্যাকশানের মুখােমুখি হতে পারেন আপনিও। আজ হােক কাল, কাল না হােল্ক পরশু। মুখােমুখি হতে পারেন আপনার শহরে, আপনার পাড়ায়, হয়তাে আপনার নিজের ঘরে। তখন টিভিকে দোষ দেবেন না। যা খুশি দেখা আর দেখানাের স্বাধীনতা পেতে চাইলে তার জন্য কিছু মূল্য তাে গুণে দিতেই হবে।”

অনুসরণে লেখা যায় : টেলিভিশনের ভালাে-মন্দ।

              জনমানসে টেলিভিশনের ভূমিকা।