রূপনারানের কূলে – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর | উচ্চমাধ্যমিক বাংলা পাঠ্য বইয়ের কবিতা

 

রূপনারানের কূলে MCQ
রূপনারানের কূলে SAQ
 
রূপনারানের কূলে – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
 

রূপনারানের কূলে

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

রূপ-নারানের কুলে
জেগে উঠিলাম,
জানিলাম এ জগৎ
স্বপ্ন নয়।
রক্তের অক্ষরে দেখিলাম
আপনার রূপ,
চিনিলাম আপনারে
আঘাতে আঘাতে
বেদনায় বেদনায়;
সত্য যে কঠিন,
কঠিনেরে ভালােবাসিলাম,
সে কখনাে করে না বঞ্চনা।
আমৃত্যুর দুঃখের তপস্যা এ জীবন,
সত্যের দারুণ মূল্য লাভ করিবারে,
মৃত্যুতে সকল দেনা শােধ করে দিতে।

বিষয়-সংক্ষেপ

কবি রূপনারানের কূলে জেগে উঠলেন। এ জগৎ স্বপ্ন নয়, তিনি জানলেন। দেখলেন রক্তের অক্ষরে তাঁর আপনার রূপ লেখা। আঘাত আর. বেদনার মাঝে তিনি নিজেকে চিনলেন। সত্য কঠিন। কবি সেই কঠিনকে ভালােবাসলেন। দুঃখের মধ্য দিয়ে যে সিদ্ধিলাভ ঘটে, তা কখনও বঞ্চনা করে না। জীবনভর দুঃখের তপস্যা চলে। দুঃখের তপস্যায়, সত্যের দারুণ মূল্য দিয়ে জীবনের সকল দেনা শােধ করে কবি মৃত্যুর হাতে নিজেকে নিশ্চিন্তে সমর্পণ করে দিতে প্রয়াসী।

উৎস

কাব্যগ্রন্থ ‘শেষলেখা’: রবীন্দ্রনাথের মহাপ্রয়াণের কিছুদিন পরে ‘শেষলেখা কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হয় ১৩৪৮ বঙ্গাব্দের ভাদ্র মাসে (আগস্ট- সেপ্টেম্বর ১৯৪১ খ্রি.)। এই গ্রন্থে একটি গানসহ ১৫টি কবিতা সংকলিত হয়েছে। এই গ্রন্থের না জেলার বিজ্ঞপ্তি পত্রে কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ লিখেছেন, “এই গ্রন্থের নামকরণ পিতৃদেব করিয়া যাইতে পারেন নাই। শেষলেখা-র কয়েকটি কবিতা তাঁহার স্বহস্তলিখিত, অনেকগুলি শয্যাশায়ী অবস্থায় মুখে মুখে রচিত, নিকটে যাঁহারা থাকিতেন তাঁহারা সেইগুলি লিখিয়া লইতেন, পরে তিনি সেইগুলি সংশােধন করিয়া মুদ্রণের অনুমতি দিতেন।

রচনার স্থান ও কাল: ‘রূপনারানের কূলে’ কবিতাটি ‘শেষলেখা কাব্যগ্রন্থের ১১ নং কবিতা। এটি রচিত হয়েছিল ৩০ বৈশাখ, ১৩৪৮ (১৩ মে চকাে ১৯৪১ খ্রি) বঙ্গাব্দে। শান্তিনিকেতনের উদয়নে কবিতাটি রচিত হয়, তখন রাত্রি ৩টে বেজে ১৫
মিনিট। ‘আলাপচারী রবীন্দ্রনাথ’ গ্রন্থে ‘রানী চন্দ লিখেছেন, ভােরবেলা গুরুদেবের ঘরে ঢুকে দেখি তিনি তখনাে ঘুমুচ্ছেন, তাঁর বিছানার পাশে একখানি ছােটো কাগজে লেখা আছে, কয়েক লাইন কবিতা। শেষরাত্রে গুরুদেব বলেছেন কাছে যিনি ছিলেন লিখি রেখেছেন : রূপনারানের কূলে……ভালােবাসিলাম।

সংযােজন: আমি সেখানা নিয়ে কবিতাটি আর-একটি কাগজে বড়াে বড়াে করে লিখে রেখে দিলুম। ছােটো লেখা পড়তে গুরুদেবের কষ্ট হয়। গুরুদেব জাগলেন, হাতমুখ ধােওয়ার পর কবি খেলেন। পরে কবিতাটি তাঁকে দেখালুম। তিনি কাগজটি আমার হাতে দিয়ে বললেন, আরাে কয়েক লাইন লিখে রাখ : ‘সে কখনাে করে বঞ্চনা। ……মৃত্যুতে সকল দেনা শােধ করে দিতে।

প্রথম প্রকাশ ও উৎস: কবিতা প্রকাশিত হয় ‘আনন্দবাজার পত্রিকায়, ২৪ শ্রাবণ ১৩৪৮ বঙ্গাব্দে। রবীন্দ্রনাথের লেখা ‘শেষলেখা কাব্যগ্রন্থ থেকে ‘রূপনারানের কূলে’ কবিতাটি সংকলিত।

কবি-পরিচিতি

ভূমিকা: রবীন্দ্রনাথ বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এক অসাধারণ প্রতিভাবান কবি। কবি হিসেবে তিনি বিশ্বখ্যাতির অধিকারী হলেও সাহিত্যের সকল শাখাতেই তিনি অসাধারণ সৃজনশীলতার বিস্ময়কর স্বাক্ষর রেখেছেন। তাঁর সুমহান ও চিরায়ত সৃষ্টি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে বিশ্বের দরবারে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

জন্ম, পিতৃপরিচয়, শিক্ষা: রবীন্দ্রনাথের জন্ম কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারে ৭ মে ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দে। পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, মাতা সারদা দেবী। রবীন্দ্রনাথ পিতা-মাতার চতুর্দশ সন্তান। ওরিয়েন্টাল সেমিনারি, নর্মাল স্কুল, বেঙ্গল অ্যাকাডেমি, সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুলে তাঁর অধ্যয়নপর্ব চললেও তিনি স্কুলের পাঠ সম্পূর্ণ করেননি। স্কুলের প্রথাগত শিক্ষালাভ না হলেও বিভিন্ন গৃহশিক্ষকের কাগ তত্ত্বাবধানে বাড়িতে তাঁর অধ্যয়ন ও জ্ঞানার্জনের কাজ চলতে থাকে। তিনি সংস্কৃত, ইংরেজি ও বাংলা ভাষাতে পারদর্শী হয়ে ওঠেন। বিদ্যাচর্চার সঙ্গে সঙ্গে সংগীতে ও অঙ্কনে অসাধারণ নৈপুণ্যের অধিকারী হন। দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ও বউঠান কাদম্বরী দেবীর সস্নেহ প্রভাব তাঁর কাব্যসাধনার ক্ষেত্রে উল্লেখযােগ্য ভূমিকা গ্রহণ করে। ব্যারিস্টারি পড়ার জন্য কবি সতেরাে বছর বয়সে বিলাতে প্রেরিত হন। শেষাবধি তাঁর ব্যারিস্টারি পড়া হয়ে ওঠেনি।

কবিপ্রতিভার উন্মেষ: রবীন্দ্রনাথের প্রথম মুদ্রিত কবিতা ‘হিন্দু মেলার উপহার। বনফুল’, ‘কবিকাহিনী’, ‘ভানুসিংহের পদাবলী’, ‘শৈশব সংগীত’, ‘রুদ্রচণ্ড প্রভৃতি অনেকগুলি কাব্যগ্রন্থ মাত্র আঠারাে বছর বয়সের মধ্যে কবি লিখে ফেলেন। ‘ভারতী’ ও ‘বালক’ পত্রিকায় কবি ছিলেন নিয়মিত লেখক। কবির বয়স তখন বাইশ, একাদশবর্ষীয়া ভবতারিণীর সঙ্গে কবি পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন। ভবতারিণীর নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় মৃণালিনী। ঠাকুর পরিবারে জমিদারি দেখাশােনা করতেন জামাতা সারদাপ্রসাদ। তাঁর মৃত্যুর পর জমিদারি দেখাশােনার দায়িত্ব বর্তায় তরুণ কবি রবীন্দ্রনাথের ওপর।

বিবাহ, জমিদারি দেখাশােনা: দেখাশােনার অবসরে উদার প্রকৃতি ও বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের নিকট-সান্নিধ্যে আসেন কবি। প্রকৃতি ও মানুষ হাত-ধরাধরি করে তাঁর কবিতায় ও অন্যান্য রচনায় স্বচ্ছন্দ ও অবাধ স্থান করে নেয়। কবিতা, গান, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নাটক—অজস্র রচনায় বঙ্গভারতীর ভাণ্ডার যেন অমূল্য রত্নসম্ভারে পূর্ণ হয়ে ওঠে।

স্বদেশবাৎসল্য: রবীন্দ্রনাথ স্বদেশবৎসল কবি। তাঁর দেশাত্মবােধের প্রেরণা প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষভাবে জাতীয় আন্দোলনে জুগিয়েছে অসাধারণ প্রাণশক্তি। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন উপলক্ষ্যে তাঁর রচিত ‘বাংলার মাটি, বাংলার জল’ গান শুধু ইতিহাস নয়, কবির স্বদেশপ্রেমের সার্থক পরিচয়বাহক। ইংরেজের শাসন-পীড়নের নিষ্ঠুরতার প্রতিবাদে কবি সােচ্চার হতে দ্বিধা করেননি। জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে কবি ‘নাইট’ উপাধি ত্যাগ করেন।


[su_posts template=”templates/list-loop.php” posts_per_page=”10″ tax_term=”91″ order=”desc” ignore_sticky_posts=”yes”]

[sc name=”last”]