প্রাত্যহিক জীবনে জল

প্রাত্যহিক জীবনে জল

ভূমিকা : 

জলের অপর নাম জীবন—একথা কে না জানে? সৌর পরিবারের সদস্যদের মধ্যে শুধুমাত্র পৃথিবীতেই তরল অবস্থায় জলের অফুরন্ত ভাণ্ডার রয়েছে। মহাকাশ থেকে পৃথিবীকে তাই উজ্জ্বল নীল বর্ণের দেখায়। জলের উপস্থিতির জন্যই এই গ্রহে প্রাণের উদ্ভব ও বিকাশ সম্ভব হয়েছে। প্রাত্যহিক জীবনে জলের গুরুত্ব সম্পর্কে তাই কোন সন্দেহ নেই।

তবে জলের যথাযথ ব্যবহার, জলদূষণ,জল বিভাজিকা নিয়ন্ত্রণ প্রভৃতি বিষয়ে এখনই না সচেতন হলে প্রাত্যহিক জীবনে যে জল আমাদের জীবনধারণের ক্ষেত্রে অপরিহার্য উপাদান রূপে স্বীকৃত হয়েছে, তাতে আগামী দিনে সংকট দেখা দেবে।

জলমণ্ডল: 

পৃথিবীর প্রায় শতকরা ৭১ ভাগ ভৌগােলিক অংশ অধিকার করে রয়েছে বিশাল সামুদ্রিক জলরাশি এবং বাকি ২৯ ভাগ স্থলভাগেও আছে কিছু পরিমাণ ভূগর্ভস্থ জল, নদী-নালা, খাল-বিল। আনুমানিক পৃথিবীর সর্বোচ্চ জলরাশির পরিমাণ হল ১৪০ কোটি ঘন কিলােমিটার। জীবেরা জীবনধারণের জন্য এই জলসম্পদ স্থলভাগের জলাধার ও ভূগর্ভস্থ জল থেকে সংগ্রহ করে। সামুদ্রিক জলের ব্যবহার ঠিক ততটা সম্ভবপর হয় না। সুবিশাল জলরাশি চক্রাকারে পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে বায়ুমণ্ডলে ও জীবমণ্ডলে প্রবাহিত হয় এবং পরে তা আবার ফিরেও আসে।

জলের গুরুত্ব :

জীবদেহের দুই তৃতীয়াংশ জল দ্বারা গঠিত। জলের আপেক্ষিক তাপ ও দ্রাব্যতা খুব বেশি হওয়ার জন্য জীবের যাবতীয় শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়ায় জল ব্যবহৃত হয়। জলের বিশেষ ধর্মগুলি হলঃ ভৌত অবস্থা, ঘনত্ব, তাপ ধারকত্ব, দ্রাব্যতা, আলােক প্রবেশ্যতা, তাপ পরিবাহিতা, সান্দ্রতা, আসন ইত্যাদি। জলের এই ধর্ম জীবদেহে বিভিন্ন বস্তুর সংবহনে উল্লেখযােগ্য ভূমিকা পালন করে।

জলের উৎস :

জলসম্পদের শতকরা ৯৭.২ ভাগ সামুদ্রিক জল অর্থাৎ লবণাক্ত। বাকি স্বাদু জলের বেশির ভাগই তুষার ও হিমবাহ হিসেবে প্রকৃতিতে রয়েছে। ভূগর্ভের ও ভূপৃষ্ঠের স্বাদু জলই সাধারণত আমরা দৈনন্দিন গৃহস্থালীর ও শিল্পের কাজে লাগাই। স্বাদু জলের উৎস হল—ভূপৃষ্ঠ ও ভূগর্ভ। ভূপৃষ্ঠের জলের উৎস দুধরনের—স্থির জলের উৎস (পুকুর, হ্রদ, সরােবর প্রভৃতি) এবং প্রবহমান জলের উৎস (নদ-নদী, ঝর্ণা প্রভৃতি)।

জলের ব্যবহার :

আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে জলের ব্যবহার খুব ব্যাপক। পানীয় হিসেবে, খাদ্যদ্রব্য প্রস্তুতিতে, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য, সেচের জন্য প্রচুর জল ব্যবহৃত হয়। বিনােদনের জন্যও প্রচুর জল ব্যবহার করা হয়। কল-কারখানায় ও বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের অধিক চাপে জলীয় বাষ্প উৎপাদন করার জন্য, শীতলীকরণের জন্য এবং বর্জ্য পদার্থ নিষ্কাশনে জল ব্যবহৃত হয়।

জলের ব্যবহারের প্রকৃতি যদি দেখা যায় তাহলে দেখা যাবে কৃষিকাজে জলের সিংহভাগ ব্যয়িত হয়, যা প্রায় ৭৩%। অন্যদিকে শক্তি উৎপাদনের জন্য ১৩.৭%, শিল্পের কাজে ৩.২% এবং গৃহস্থালীর কাজে জল ব্যবহারের পরিমাণ ৩.৫%।

জলের সংকট :

যে জল আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে প্রাণ ধারণের অন্যতম উপাদান সেই ভূগর্ভস্থ জল কৃষিকাজে ব্যবহারের ফলে সেই সঞ্চিত ভাণ্ডার শেষের পথে। ভূপৃষ্ঠে জলবিভাজিকা নিয়ন্ত্রণ ঠিক না থাকায় পুনরায় জল সঞ্চয়ের পথ বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। এমনকি কৃষি ও শিল্প বিস্তারের ফলে জলের চাহিদা অসম্ভব রকম বেড়ে চলেছে।

পৃথিবীর শিল্পোন্নত অঞ্চলগুলিতে মাটির নীচে জলরেখার সীমা ক্রমশ নীচে নেমে যাচ্ছে। তাই বর্তমানে জল ব্যবহারের ক্ষেত্রে চারটি সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে—(এক) আমাদের জলের চাহিদার সঙ্গে ব্যবহার্য জলের পরিমাণ বাড়ছে না। (দুই) মাটির তলায় জলের সঞ্চয় ক্রমশ কমে আসছে। (তিন) নদী, হ্রদ, সরােবর ও সমুদ্রের জলে বিশুদ্ধতার অবনতি ঘটছে। (চার) জলের অপচয়ও সমস্যা সৃষ্টি করছে।

জলদূষণ :

দৈনন্দিন জীবনে জল ব্যবহারের ফলে এবং প্রাকৃতিক কারণে জলের প্রাকৃতিক, রাসায়নিক ও জৈব উপাদানগুলির গুণমানের অবনমন ঘটছে এবং সৃষ্টি হচ্ছে দূষণের। এর কারণগুলি হলঃ (ক) রাসায়নিক সার, কীটনাশকের জলে মিশ্রণ। (খ) ঘরগৃহস্থালীর দৈনন্দিন আবর্জনা জলে যুক্ত হওয়া। (গ) শিল্পের আবর্জনা ও বর্জ্য পদার্থ জলে মিশে যাওয়া।

(ঘ) অতিরিক্ত ডিটারজেন্টের ব্যবহার। (ঙ) অ্যাসিড বৃষ্টি। (চ) বিভিন্ন ধরনের ব্যাকটিরিয়া, ভাইরাস, প্রােটোজোয়ার আবির্ভাব। (ছ) শিল্পাঞ্চলের ছাই ও তৈলাক্ত পদার্থ জলে মিশে যাওয়া। (জ) তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের গরম জল ও ছাই হ্রদ, নদী, খাল-বিলে মিশে যাওয়া। (বা) শহরাঞ্চলের নর্দমার জল-এর মিশ্রণ ইত্যাদি। তাছাড়া আর্সেনিক দূষণও জলবাহিত রােগ ও জলদূষণের অবশ্যম্ভাবী ফল।

দূষণের প্রভাব :

প্রাত্যহিক জীবনে জল ব্যবহার যে দূষণ সৃষ্টি করছে তার প্রভাব বেশি পড়ছে মানবশরীরে। যেমন, জন্ডিস, কলেরা, আন্ত্রিক, চর্মরােগ প্রভৃতি জলদূষণের প্রভাবে সৃষ্ট হচ্ছে। সেইসঙ্গে জলে অতিরিক্ত ক্লোরিন ব্যবহারের ফলে অ্যালার্জি, পক্ষাঘাত, মূত্রথলির রােগ সৃষ্টি হচ্ছে। ফলে লৌহ, সায়ানাইড, তামা প্রভৃতির জন্য পেটের রােগ ও চর্মরােগ হচ্ছে।

শুধু মানবদেহে নয়, পরিবেশের উপরও দূষণের প্রভাব বিস্তারিত হচ্ছে। কেননা এই দূষণের ফলে মাটির উর্বরতা হ্রাস পাচ্ছে, ভৌম জলে ক্ষারের পরিমাণ বৃদ্ধি হচ্ছে। শস্যের গুণগত মান ও স্বাদের পরিবর্তন ঘটছে। উদ্ভিদের শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তন সাধিত হচ্ছে।

উপসংহার :

জল ব্যবহারের ফলে স্বাভাবিক ভাবেই যে দূষণ সৃষ্টি হচ্ছে তার প্রতিরােধের জন্য চাই—ব্যক্তিগত প্রচেষ্টা, প্রযুক্তিগত প্রচেষ্টা এবং প্রশাসনিক পদক্ষেপ। ব্যক্তিগত স্তরে চাই সচেতনতা বৃদ্ধি ও জলের যথাযথ ব্যবহার সম্পর্কে সম্যক ধারণা এবং জলের অপচয় রােধ করা। প্রযুক্তির মাধ্যমে বিভিন্ন বর্জ্য জল, নদীর জলকে শােধন করা। প্রশাসনিক ক্ষেত্রে আইন রক্ষা করার ব্যবস্থা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা রূপায়ণ প্রয়ােজন। তাহলে যে জলের অপর নাম জীবন এবং যে জল না হলে প্রাত্যহিক জীবনে সংকট সৃষ্টি হয়—সেই জীবনের প্রয়ােজনে জলের ব্যবহার আরাে স্বাভাবিক ও সংকটমুক্ত হতে পারবে।


[su_posts template=”templates/list-loop.php” posts_per_page=”3″ tax_term=”1392″ order=”desc” orderby=”rand”]