নদীমাতৃক সভ্যতা গড়ে ওঠার কারণ

প্রাচীন কালে পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় নদীমাতৃক সভ্যতা গড়ে ওঠার পেছনে বিভিন্ন কারণ ছিল। যেমন—

1. উর্বর কৃষিজমি: আদিম মানুষ লক্ষ করেছিল যে নদীতে প্লাবনের ফলে নদীর দুকূল ছাপিয়ে যখন বন্যার জল উপত্যকা অঞলে ছড়িয়ে পড়ে তখন উপকূল অঞলে নদীর পলিমাটি সঞ্জিত হয়। এই পলিমাটি সমৃদ্ধ জমি খুবই উর্বর এবং এই জমিতে তুলনামূলকভাবে বেশি ফসল উৎপাদিত হয়।

2. জলসেচের সুবিধা : নদীর উপকূল অঞ্চলে চাষবাস করলে জলসেচের সুবিধা পাওয়া যায়। নদীতে বাঁধ দিয়ে এবং সেখান থেকে খাল কেটে কৃষিজমিতে জলসেচ করা সম্ভব হয়। জলসেচের ফলে কৃষি উৎপাদন যথেষ্ট বৃদ্ধি পায়। কৃষি উৎপাদনের সুবিধার্থে আদিম মানুষ দলবদ্ধভাবে বিভিন্ন নদীর উপত্যকা অঞ্চলে বসতি গড়ে তুলেছিল।

3. পশুপালনের সুবিধা: নদী, হ্রদ বা দীঘির তীরবর্তী অঞল যথেষ্ট উর্বর হওয়ায় এবং সেখানে জলের সরবরাহ থাকায় জলাশয় সংলগ্ন বিস্তীর্ণ অঞলে তৃণভূমির প্রসার ঘটত। এই তৃণভূমি আদিম মানুষের পশুপালনের পক্ষে বিশেষ সহায়ক হত। কেননা, মানুষের গৃহপালিত পশুর অধিকাংশই হত তৃণভােজী। মানুষ নদী-উপত্যকা বা হ্রদের নিকটবর্তী বিস্তৃত তৃণভূমি অঞলে পশুচারণ করতে পারত। পশুপালনের ক্ষেত্রে নদী বা হ্রদের তীরে বসবাস করাই আদিম মানুষের পক্ষে বিশেষ সুবিধাজনক ছিল।

4. পণ্য পরিবহণ ও যাতায়াতের সুবিধা: প্রাচীন কালে স্থলপথে দুরদুরান্তে যাতায়াত বা পণ্য পরিবহণের বিশেষ সুযােগসুবিধা ছিল না। নদীর তীরে বসবাস করলে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাতায়াত এবং পণ্য পরিবহণের বিশেষ সুবিধা হয়—এই বিষয়টি আদিম মানুষ ভালােভাবেই উপলদ্ধি করেছিল। কৃষিকাজ শুরু করার পর উৎপাদিত শস্য ও অন্যান্য পণ্য দূরাদূরান্তে পাঠানাের জন্য নদীপথই ছিল সবচেয়ে উপযােগী।

5. মাছ শিকার; আদিম মানুষ যখন যাযাবর জীবন ছেড়ে কৃষিকাজে নিযুক্ত হল তখন শিকার করে মাংস সংগ্রহের পরিমাণ কমতে শুরু করল। কিন্তু নদীর তীরে বসবাস করে মানুষ তা পুষিয়ে নিতে পারল মাছ ধরে। নদী ও হ্রদে প্রচুর মাছ পাওয়া যেত। মানুষ তখনকার অনুন্নত হাতিয়ার ব্যবহার করেই নদী থেকে প্রচুর মাছ ধরত। উৎপাদিত খাদ্যশস্য এবং নদীর মাছ ধরার ফলে তখনকার মানুষের খাদ্যের কোনাে অভাব হত না।

6. অধিক নিরাপত্তা: আদিম যুগে শিকার, সম্পদ সংগ্রহ ও অন্যান্য কারণে বিভিন্ন গােষ্ঠীর মানুষের মধ্যে প্রায়ই সংঘর্ষ বাধত। তাই প্রতিটি জনগােষ্ঠীর কাছে নিরাপত্তার বিষয়টি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। মানুষ উপলব্ধি করেছিল যে, জলভাগহীন বিস্তীর্ণ স্থলভাগে বসবাস করলে যখন তখন অন্য গােষ্ঠীর দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার ভয় থাকে। কিন্তু নদীর জলরাশি অতিক্রম করে সহসা এরূপ আক্রমণ সম্ভব নয়। তাই প্রাকৃতিক নিরাপত্তার কারণেও মানুষ নদীর তীরে বসবাস করত।

 7. অনুকূল আবহাওয়া : নদী বা বড়াে জলাশয়ের ধারে।আবহাওয়া তুলনামূলকভাবে আরামদায়ক হয়। জলরাশি থেকে দূরবর্তী স্থানে গ্রীষ্মকালে বেশি গরম এবং শীতকালে বেশি শীত অনুভূত হয়। কিন্তু জলাশয়ের নিকটবর্তী অঞলে আবহাওয়া সেই তুলনায় নাতিশীতােয় হয়। এজন্য নদী বা বড় হ্রদের উপকূলে প্রাচীন মানুষ তাদের বসতি গড়ে তুলতে চাইত।।

8. পানীয় জলের সুবিধা: আদিম মানুষের কাছে পানীয় জলের একমাত্র উৎস ছিল নদীনালা বা হ্রদের জল।।