ধর্ম ও বিজ্ঞান রচনা

ধর্ম ও বিজ্ঞান

ভূমিকা :

  “মহাবিশ্বে মহাকাশে মহাকাল মাঝে/আমি মানব একাকী ভ্রমি বিস্ময়ে।”—রবীন্দ্রনাথ মহাবিশ্বের লীলাবৈচিত্র্য দেখে বিস্ময়ে এ গান গেয়েছিলেন। বিজ্ঞান এই মহাবিশ্বের রহস্য মােচনে, বিস্মিত মানুষকে উপাদান যুগিয়ে মানুষের প্রগতির সঙ্গী হয়ে উঠেছে।

বিশ্লেষণী মননে, জ্ঞানের আলােকে বিজ্ঞান খুঁজে চলেছে মহাজাগতিক ও জাগতিক রহস্যের ব্যাখ্যা। অন্যদিকে ধর্মের নামে ধর্মন্ধরা বিজ্ঞানের এই অগ্রগতিকে রুদ্ধ করতে চেয়ে লিওনার্দো দা ভিঞ্চি, সক্রেটিস, গ্যালিলিও, আর্কিমিডিসকে শাস্তি দিয়েছিল।

কিন্তু তাতে বিজ্ঞানের অগ্রগতি থেমে থাকেনি। ধর্ম ও বিজ্ঞানে কেউ কারাের প্রতিস্পর্ধী নয়, বরং তা পরস্পর পরস্পরের পরিপূরক।

ধর্ম ও বিজ্ঞানের স্বরূপ :

আইনস্টাইন লিখেছেন, ‘Science without religion is lame and religion with- out science is blind.’ অন্যদিকে কার্ল মার্কস বলেছিলেন, ‘Religion is the sign of the oppressed creature, the heart of the heartless world. Just as it is the spirit of a spiritless situation, it is the opium of the people.’ আসলে ধর্ম শব্দটির ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হল যা সমাজকে বা ব্যক্তিকে ধারণ বা পােষণ করে।

স্বামী বিবেকানন্দের মতে, ধর্ম হল মানুষের মধ্যে থাকা দেবত্বের বিকাশ। সেজন্য ধর্ম যেমন ব্যক্তির মধ্যে মনুষ্যত্ববােধকে জাগ্রত করে, তেমনি তা সমাজে শৃঙ্খলা রক্ষায় সাহায্য করে।

অন্যদিকে বিজ্ঞান হল যুক্তি পরম্পরায়, পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে এই জগত ও জীবনের রহস্যকে সন্ধান করে আবিষ্কার করে। মানুষের তথা সমাজের প্রগতিতে ধর্ম ও বিজ্ঞান উভয়েরই গুরুত্ব যথেষ্ট।

ধর্ম ও বিজ্ঞানের সম্পর্ক :

  রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ধর্ম নহে সম্পদের হেতু, নহে তা সুখের ক্ষুদ্র সেতু; ধর্মেই ধর্মের শেষ। কেননা ধর্মের দৃষ্টি ব্যাপক ও গভীর। অন্যদিকে বিজ্ঞান মানুষের বহুমুখী কল্যাণ কর্ম করার ব্রতে সদা সচেষ্ট। তাই ধর্ম ও বিজ্ঞান উভয়ই মানব কল্যাণে নিয়ােজিত।

কিন্তু ধর্ম ও বিজ্ঞান উভয়ের অশুভ দিকও আছে। কারণ ধর্মের নামে ধর্মান্ধরা যেমন বিজ্ঞানীদের কণ্ঠরােধ করতে চেয়েছিল তেমনি বিজ্ঞানের অপব্যবহারকারীরাও মানুষের মারণযজ্ঞে বিজ্ঞানকে নিয়ােজিত করেছিল।

কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রাস্তা কারও একার নয়’ কবিতায় এই দুই বিষয়ের পদস্খলন অপূর্বভাবে তুলে ধরেছেন। যেমন,

  বিজ্ঞান কি তখন থেমেছিল? তীর্থের পাণ্ডাদের হই হই, তাদের লাল চোখ কি পেরেছিল পৃথিবীকে বেঞ্চের উপর দাঁড় করিয়ে সূর্যকে তার চারদিকে ওঠবােস করাতে?

কিম্বা —

  বিজ্ঞান যখন প্রেমের গান ভুলে ভাড়াটে জল্লাদের পােশাক গায়ে চাপায়, আর রাজনীতির বাদশারা পয়সা দিয়ে তার ইজ্জত কিনে নেয়, আর তার গলা থেকেও ধর্মের যাঁড়েদের মতােই কর্কশ আদেশ শােনা যায় ? রাস্তা ছাড়াে! নইলে —

  সুতরাং ধর্ম ও বিজ্ঞান উভয়েরই অশুভ শক্তি ভয়ংকর। দ্বিতীয়ত, ধর্ম জীবনের শাশ্বত সত্যকে আবিষ্কার করে। কিন্তু বিজ্ঞানের সত্য কালে কালে পাল্টায়।

তৃতীয়ত, ধর্ম মানুষের আবেগ ও উপলদ্ধিজাত বিশ্বাস; বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে সেই আবেগ ও বিশ্বাস থাকলেও তা যুক্তিনির্ভর, সেখানে আবেগের স্থান কম। চতুর্থত, বিজ্ঞান মানুষকে কৃত্রিম করে তুলতে পারে। কিন্তু প্রকৃত ধর্ম মানুষকে গতিশীল করে।

মানবজীবনে ধর্ম ও বিজ্ঞানের প্রয়ােজনীয়তা

   বিজ্ঞান মানুষকে পার্থিব আনন্দ দেয়, ধর্ম দেয় আত্মার আনন্দ—দুঃখে, বিপদে মানুষকে বাঁচবার প্রেরণা দান করে। পার্থিব ও অপার্থিব দুই সত্তাকে পেতে গেলে মানুষকে যুগপৎ বিজ্ঞান ও ধর্মের উপর আস্থা রাখতেই হবে।

পৃথিবীতে যতদিন প্রেমের গান থাকবে, জীবনে স্বপ্ন থাকবে ততদিন বিজ্ঞান ও ধর্মের প্রয়ােজনীয়তা থাকবে। ধর্মের উদ্দেশ্য হল মানুষকে বেঁচে থাকার সাহস যােগানাে, বিজ্ঞানের উদ্দেশ্যও মানুষের বেঁচে থাকার রসদ যােগাননা।

ধর্ম-দর্শনকে বাদ দিয়ে শুধু বিজ্ঞানসর্বস্ব সভ্যতা রস ছাড়া আখের মতােই নীরস। পৃথিবীতে বেঁচে থাকার জন্য সম্পদ চাই, সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার চাই—এই চাওয়াকে বাস্তবায়িত করে বিজ্ঞান।

কিন্তু সমস্ত পেয়েও মানুষ যখন অশান্তি ও নিঃসঙ্গতায় পীড়িত হয় তখন ধর্ম সেই পীড়িত মানুষকে শান্তির আশ্রয় খুঁজে দেয়। যেমন করে বনলতা সেনের চোখ দেখে হাজার বছর ধরে পথ হাঁটা ক্লান্ত পথিক বলেছিল, ‘পাখির নীড়ের মতাে চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।

অর্থাৎ বনলতা সেনের চোখে যেমন কবি আশ্রয় খুঁজে পেয়েছিলেন তেমনি ধর্মও পীড়িত মানুষকে আশ্রয়ের সন্ধান দিতে পারে।

অশুভ দিক : 

  ধর্ম ও বিজ্ঞান যে অশুভ শক্তি প্রকাশ করছে, এর দায় তাদের প্রয়ােগকারীদের। কেননা কোনাে ধর্মই বলে না অপর ধর্মের মানুষকে হত্যা করাে। কিন্তু ধর্মের ষাঁড়রা ধর্মকে ও কাজে লাগিয়ে মানুষের নিধনে তৎপর হলে ধর্মের অশুভ দিক আমাদের পীড়িত করে।

আবার বিজ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে হাইড্রোজেন বােমা, জীবাণু বােমা তৈরি করে মানুষের ধ্বংসলীলায় মেতে ওঠাও বিজ্ঞানের অশুভ শক্তিকেই প্রকাশ করে—যা আজ সারা বিশ্বের বহু আলােচিত ঘটনা।

উপসংহার :

  সুতরাং মানবধর্ম-ই ধর্মের ও বিজ্ঞানের মূল কথা হওয়া উচিত। মনুষ্যত্বের বিকাশে যে ধর্ম যে বিজ্ঞান সাহায্য করে না তা অ-ধর্ম এবং অপবিজ্ঞান। তা মানুষের পক্ষ অশুভ, মানবের প্রগতিতে অন্তরায় স্বরূপ।

 অনুসরণে লেখা যায় :  ধর্মান্ধতা ও বিজ্ঞানমনস্কতা।


[su_posts template=”templates/list-loop.php” posts_per_page=”3″ tax_term=”1392″ order=”desc” orderby=”rand”]