গ্রিক ও রােমান পৌরাণিক কাহিনি বা মিথ-এরপরিচয় দাও।

গ্রিক ও রােমান পৌরাণিক কাহিনি বা মিথ-এরপরিচয় দাও।

🔸উত্তর

সুচনা: গ্রিক মিথের প্রধান উৎস হল হােমারের দুই মহাকাব্য—ইলিয়াড ও ওডিসি। এ ছাড়াও অন্যান্য উৎসগুলি হল—টেলেগােনিয়া কাব্য, সফোক্লেস এবং এউরিপেদেস-এর ট্রাজেডিসমূহ, আপুলেইয়াসের দ্য গােল্ডেন অ্যাস, প্লাতাের টিমায়েউস, পৌসানিয়াসের গাইড টু গ্রিস প্রভৃতি রচনা। রােমান মিথের উৎস হিসেবে ভার্জিলের রচনা লিভির ইতিহাস, ডায়ােনিসুস অব হালিকার্নাসের হিস্ট্রি অব আলি, রােম, ওভিদ, ভারাে এবং সন্ত অগাস্তিনের রচনা হল উল্লেখযােগ্য।

[1] সৃষ্টির কথা:

| [i] হােমারীয় সৃষ্টি মিথ: গ্রিক সৃষ্টি কথায় বিভিন্ন কাহিনির অবতারণা লক্ষ করা যায়। হােমারের ইলিয়াড মহাকাব্যের কাহিনি অনুসারে এক কালাে ডানাযুক্ত বিরাট পাখি একটি ডিম প্রসব করে। এই ডিমটির দুই অংশ থেকে অউরানস ও গেইআ জন্ম নেন। এরা ছিলেন স্বর্গ ও মর্ত্যের রূপ এবং প্রথম জনক ও জননী হিসেবে ওকিয়ানস (সমুদ্র) এবং টেথিস (ধাত্রী)র জন্মদাতা। এরাই পরবর্তীকালে একে একে জন্ম দেয় কুনস, রিয়া, ফর্কিস এবং অন্যান্য টাইটানদের।

[ii] পেলাসগীয় সৃষ্টি মিথ: পেলাসগীয় সৃষ্টি মিথ অনুযায়ী

শুরুতে দেবী ইউরিনােম-এর উদ্ভব ঘটে। পা রাখার মতো জায়গা না পেয়ে তিনি আকাশ থেকে সমুদ্রকে আলাদা করে দেন। এরপর তিনি সমুদ্রের ঢেউয়ের ওপর নেচে নেচে দক্ষিণ দিকে এগিয়ে চলেন। তাকে অনুসরণ করে বাতাস। শুরু হয় বিশ্বসৃষ্টি প্রক্রিয়া। মহাসর্প ওফিয়ন-এর সঙ্গে ইউরিনােম মিলিত হয়ে একটি ডিম প্রসব করেন। তা থেকে সূর্য, চন্দ্র, গ্রহ, তারা, পৃথিবী, নদী, পর্বত, বৃক্ষ ও প্রাণীকূল জন্ম নেয়।
[iii] অলিম্পীয় সৃষ্টি মিথ: এই সৃষ্টি মিথ অনুযায়ী অসীম অন্ধকার (ক্যাওস) থেকে ধরিত্রী মাতা (গেইয়ার) জন্ম নেয়। তিনি নিদ্রিত অবস্থায় পুত্র অউরানসকে জন্ম দেন। অউরানস উর্বর বৃষ্টিপাত ঘটিয়ে ঘাস, বৃক্ষ, পুষ্প, পশুপাখির জন্ম দেন। সৃষ্টি হয় নদী, হ্রদ ও সমুদ্রের। এরপরে জন্ম হয় টাইটানরা।
[2] মানুষের জন্ম কাহিনি: মানুষের জন্ম তথা মানবজাতির বিকাশ নিয়ে গ্রিসের নানা ধরনের মিথের প্রচলন লক্ষ করা যায়। অ্যাথেনীয়দের ধারণা অনুযায়ী পৃথিবীর আদি মানুষ কেন্স এথেন্সের মাটি থেকে জন্ম নেয়। বােয়েশীয়রা মনে করে আদিমানব আলালকোমেনেউস কোপেই হ্রদে মাছের আকারে জন্ম নেয়। আর্কাদিয়ার জনগােষ্ঠীর বিশ্বাস বিশ্বের প্রথম মানুষ হল পেলাসগসই। অন্যমতে অলিম্পাসের দেবতা জিউস-এর আদেশে এইজিনার দ্বীপের পিঁপড়েগুলাে মানুষের আকার নেয়। এবং তারা রাজা আইয়াকোস-এর প্রজা হয়।
[3] মহাপ্লাবন: প্রাচীন সুমেরীয়দের মতাে গ্রিকরাও মহাপ্লাবনের কাহিনিতে বিশ্বাস করত। এই কাহিনি
অনুযায়ী দেবতা জিউস ব্রোঞ্জ যুগের মানুষদের পাপের। অপরাধে ধ্বংস করার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি পৃথিবীতে একটানা বৃষ্টিপাত ঘটান। প্রবল বর্ষণে সমস্ত মানুষ ভেসে যায়। কয়েকজন পাহাড়ে গিয়ে আশ্রয় নেয়। এদিকে দিউকালিয়ন পিতা প্রমেথেউসের আদেশ মেনে যে সিন্দুক তৈরি করেছিল
তার ওপর সে ও তার স্ত্রী পিরহা ভেসে রইল। বর্ষণ বন্ধ হলে দিউকালিয়ন জিউসের কাছে এক নতুন মানবজাতির প্রার্থনা করলেন। জিউস তার প্রার্থনায় সাড়া দিয়ে দিউকালিয়নকে ভূমি থেকে কিছু পাথর কুড়িয়ে তার মাথার ওপর দিয়ে ছোড়ার আদেশ দিলেন। এই পাথরগুলি থেকে জন্ম নিলেন পুরুষেরা। দিউকালিয়ন-এর স্ত্রী পিরহা একইরকমভাবে পাথর ছুঁড়লে জন্ম হয়, নারীদের।

রােমান মিথ

[1] রোম সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠার কাহিনি: প্রাচীন রােমান পৌরাণিক কাহিনি অনুযায়ী টাইবার নদীর তীরে সাতটি পাহাড় ছিল। এর মধ্যে অন্যতম ছিল এলবান পাহাড়ের শাসক পােকাসের দুই ছেলে লুমিটার এবং এমুলিয়াস। এমুলিয়াস সিংহাসন দখল করে লুমিটারের একমাত্র ছেলেকে খুন করলেন।
লুমিটারের মেয়ে সিলভিকাকেও বিবাহ করতে দিলেন না। কিন্তু মার্স দেবতার বরে সিলভিকা যমজ সন্তানের জন্ম দেন। এতে। ক্ষুদ্ধ হয়ে এমুলিয়াস সিলভিকাকে হত্যা করে তার যমজ সন্তানদের নদীর জলে ভাসিয়ে দিলেন। কথিত আছে, একটি বাঘিনী শিশু দুটিকে উদ্ধার করে নিজের শাবকের মতাে পালন করতে থাকে। এরপর এক চাষি তাদের নদীর তীর থেকে উদ্ধার করলেন। এদের একজন রােমুলাস ও অপরজন রিমাস। দুই ভাই মিলে এমুলিয়াসকে হত্যা করে লুমিটারকে পুনরায় সিংহাসনে বসালেন। এরপর সেই রাজ্যে না থেকে দুই ভাই। টাইবার নদী তীরের অন্য এক পাহাড়ে বসবাস শুরু করলেন এবং এক নতুন শহরের প্রতিষ্ঠা করলেন। শহরের নামকরণ নিয়ে দুই ভাইয়ের মধ্যে সংঘর্ষ বাধল। এতে রিমাসকে হত্যা করে রােমুলাস জয়ী হলেন। রােমুলাসের নাম অনুসারে শহরটি নাম হল রােম। প্রতিষ্ঠা হল রােম সাম্রাজ্যের।
[2] সৃষ্টি রহস্য: এক্ররীয় মিথােলজিতে বিশ্বতত্ত্ব তথা সৃষ্টি রহস্যের উল্লেখ মেলে। এই তত্ত্বে বলা হয় স্রষ্টা বারােটি সহস্রাব্দকে বিশ্ব সৃষ্টির কাজে লাগান এবং সেগুলিকে বারােটি রাশির চিহ্ন দেন। এক একটি সহস্রাব্দে এই বিশ্বের এক একটি উপাদান তৈরি হয়। প্রথম সহস্রাব্দে বিশ্ব স্রষ্টা তৈরি করেন স্বর্গ
ও পৃথিবী। এরপর একে একে দ্বিতীয় সহস্রাব্দে আকাশ, তৃতীয় সহসাব্দে ভূমি ও জল, চতুর্থ সহস্রাব্দে সূর্য ও নক্ষত্র মণ্ডল, পঞম সহস্রাব্দে বাতাস, ষষ্ঠ সহস্রাব্দে মানুষ সৃষ্টি হয়। বলা হয় ছয় সহস্রাব্দ জুড়ে এরা টিকে থাকবে এবং তারপরে ধ্বংস হয়ে যাবে। এক্রেরীয় মিথােলজিতে প্রথম কীভাবে মানুষ তৈরি হল  বর্ণনা রয়েছে। বলা হয়েছে প্রথম মানুষ ছিলেন টাগেস। যিনি লাঙলের ফলায় ওঠা কাদা থেকে সৃষ্ট হন।
[3] ভার্জিলের ঈনিড: ভার্জিলের ঈনিড কাব্যে ট্রোজান বংশের আইয়েনিয়াসের ভ্রমণ কাহিনিকে মূল বিষয় হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। কাহিনিটি হল—আইনেয়াস হল আনকিসেস ও ভীনাস-এর পুত্র। ট্রয় নগরী ধ্বংস হওয়ার পর সে তার পিতা ও ছােট্টো পুত্র জুনুসকে নিয়ে এক দীর্ঘ অভিযান চালায়। দেবতা অ্যানেলাের মন্দিরে দৈববাণী থেকে সে জানতে পারে তাদের পূর্বপুরুষের ঠিকানা খুঁজে বের করতে পারলে সেখানেই তাদের নতুন আবাস ভূমি গড়ে উঠবে। এভাবেই বহু উত্থান পতনের মধ্য দিয়ে আইয়েনিয়াস একসময় টাইবার নদীর মােহনায় আসেন। এই অঞ্চলের তখন রাজা ছিলেন লাতিনুস। রাজা আইয়েনিয়াসের সঙ্গে নিজের কন্যা লাভিনিয়ার বিবাহ স্থির করেন। লাভিনিয়ারকে বিয়ের পর আইয়েনিয়াস লাতিউমে এক নতুন নগরী লাভিনিয়াম গড়ে তােলেন।