শাবলতলার মাঠ – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় | মাধ্যমিক সম্পূর্ণ গল্প | WBBSE

মাধ্যমিক অন্যান্য বিষয়
Madhyamik Suggestion (মাধ্যমিক সাজেশন )
প্রথম পাঠ

শাবলতলার মাঠ

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

অনেক দিন পরে শাবলতলার মাঠ দেখলাম সেদিন। আমার পিসিমার বাড়ির দেশে। ছেলেবেলায় যখন পিসিমার বাড়ি থেকে দুর্গাপুর উচ্চ প্রাইমারি পাঠশালায় পড়তাম সে আজ পঁচিশ-ত্রিশ বছর আগের কথা। পিসিমা মারা যাওয়াতে সে গ্রামে আর যাইনি কখনও।

সেদিন আবার কার্যোপলক্ষে গােরুর গাড়ি চড়ে যেতে যেতে শাবলতলার মাঠ চোখে পড়ল, কিন্তু মস্ত বড়াে কী এক কারখানা হচ্ছে সেখানে। রেল লাইন বসেছে মাঠের ওপর দিয়ে বড়াে রেল লাইন। কত যে লােহালক্কড় যন্ত্রপাতি এসে পড়েছে! লােকজন কুলিমজুরের ভিড়, দুমদাম শব্দ, সে কী বিরাট ব্যাপার।

চালাঘর ও তাঁবু চারিধারে। ইঞ্জিনিয়ার-ওভারসিয়ারের দল খেটে খেটে সারা হলাে। পাঞ্জাবি কন্ট্রাকটরের মােটর দাঁড়িয়ে রয়েছে। তারের খুঁটি বসানাে হচ্ছে, ইলেকট্রিকের ও টেলিফোনের তার খাটানাে হবে।ইটবােঝাই কাঠ-বােঝাই লরির ভিড় নতুন তৈরি চওড়া রাস্তাগুলাের ওপরে। চুনের ধুলাে, সিমেন্টের ধুলাে উড়ছে বাতাসে।

এ কী হলাে?
আমার সেই ছেলেবেলাকার শাবলতলার মাঠ কোথায় গেল? সত্যিই তা নেই। তার বদলে আছে কতকগুলাে তাবুর সারি, ইটখােলা, পাথুরে কয়লার স্তুপ, চুনের ঢিবি, কাঠের ঢিবি, লােকজনের হৈ চৈ, লরির ভিড়।

আজ সকালে মার্টিন লাইনের ছােটো স্টেশনে নেমেছি, গােরুরগাড়ি করে চলেছি পিসিমার বাড়ি গ্রামের পাশের একটা গ্রামে মেয়ের বিয়ের পাত্র খুঁজতে। রাস্তার ধারে পড়ে শাবলতলার মাঠ। হঠাৎ দেখি এই অবস্থা তার।।

গােরুরগাড়ির গাড়ােয়ানকে বলি – হারে, এটা শাবলতলার মাঠ, না?
– হ্যাঁ বাবু।
– কী হচ্ছে এখানে?
– কী জানি বাবু, কলকারখানা বসছে বােধ হয়।
– কতদূর নিয়ে?
– তা বাবু অনেক দূর নিয়ে – উই বাজিতপুর, মনসাতলা, ছাওয়াল-মারি, বেদে-পােতা, হাঁসখালির চড়া পর্যন্ত।
– গ্রামগুলাে সব কোথায়?
– সব উঠিয়ে দিয়েছে।
মনে পড়ল আমার এগারাে বছর বয়সের একটি মধ্যাহ্নদিন। আর মনে পড়ল দুর্গাপুর উচ্চ প্রাইমারি স্কুলের উমাচরণ মাস্টারকে।

উমাচরণ মাস্টার কতদিন থেকে দুর্গাপুর ইউ পি পাঠশালার হেডমাস্টারি করছিলেন তা আমি বলতে পারব না। গ্রামের রায় জমিদারদের ভাঙা কার্নিসে পায়রার বাসাওলা বৈঠকখানার একপাশে সেকেলে তক্তপােশে ছিল তার বাসা। দেয়ালে তাঁর হুঁকো ঝুলত পেরেকের গায়ে, বাঁশের আলনায় তার দুখানা আধময়লা ধুতি ও এক এবং অদ্বিতীয় পিরানটি আলতাে করে ঝােলানাে থাকত — আর থাকত তক্তপােশের নীচে একজোড়া কাঠের খড়ম। একটা টিনের বিবর্ণ তােরঙ্গ। একটা চটের-থলে-ভর্তি টুকিটাকি জিনিস। একখানা পাকা বাঁশের লাঠি এবং—সেইটেই বেশি করে মনে আছে—একগাছা তেলে-জলে পাকানাে বেত।

উমাচরণ মাস্টার আবার বই লিখতেন। আমি তখন অল্পবয়স্ক, লেখক বা সাহিত্যিকের যশােগৌরব সম্বন্ধে আমার ধারণা তখন অস্পষ্ট—তবুও মাস্টারমশায় যখন ক্লাসের টেবিলের ওপর পা তুলে গম্ভীরভাবে তার লেখা ‘আক্কেল গুড়ুম’বই পড়তেন—তখন আমরা ক্লাসসুদ্ধ ছেলে বিস্ময় ও প্রশংসাভরা দৃষ্টিতে তার দীর্ঘগুম্ফযুক্ত বসন্তের দাগ-আঁকা প্রৌঢ় মুখমণ্ডলের দিকে চেয়ে থাকতাম।

হ্যাঁ—তাঁর বই-এর নাম ছিল ‘আক্কেল গুড়ুম’—তিনি বলতেন ‘প্রহসন। আমার যা বয়স তখন তাতে ‘আক্কেল গুড়ুম’ বা ‘প্রহসন’ দুটো কথার একটারও মানে বুঝতাম না। মনে আছে বই-এর মধ্যে একটি ইংরেজি পড়া ছােকরার কথা আছে এবং পড়ার ভঙ্গিতে মনে হতাে উক্ত ইংরেজি-পড়া ছােকরা খুব ভালাে লােক নয়।

উমাচরণ মাস্টার আমাদের দিকে চেয়ে সগর্বে বলতেন – এই বই পড়ে গােবরডাঙার সেজোবাবুর শালা কী বলেছিলেন জান? বলেছিলেন, উমাচরণবাবু, আপনি কালে গিরিশ ঘােযের সমান লেখক হবেন। -বুঝলে?

আমি বলেছিলাম – গিরিশ ঘােয কে পণ্ডিত মশাই?
উমাচরণবাবু অনুকম্পার হাসি হেসে আমার দিকে চেয়ে বলেছিলেন – গিরিশ ঘােষ? জান না? হুঁ: কী-বা জান?

আমি লজ্জায় চুপ করে থাকি। কী উত্তর দেবাে? যখন সত্যই জানি নে গিরিশ ঘােষ কে, নামও কোনােদিন শুনিনি! উমাচরণ তার এই মূল্যবান প্রহসন আমাদের কাছে বিক্রি করবার চেষ্টা করতেন এবং বিক্রি অনেক করেছিলেনও। প্রত্যেক ছাত্রের বাড়ি একখানা বা দুখানা করে ‘আক্কেল গুড়ুম’ ছিলই। মাইনের টাকা দিলে খুচরাে ফেরত দেওয়ার রীতি ছিল না তাঁর। বলতেন – কত বাকি? সাত আনা ? নাও একখানা ভালাে বই নিয়ে যাও। বাড়ি গিয়ে পড়তে দিয়ে সবাইকে।

একদিন পিসিমা বললেন – হারে, মাইনের টাকা দিলাম, ন আনা পয়সা ফেরত দিলি নে?

– না পিসিমা। মাস্টারমশাই বই একখানা দিয়েছেন তার বদলে।
– কী বই?
– আক্কেল গুড়ুম।
– ওমা, সে আবার কী বই? তুই কী বলে সেই বই আনতে গেলি? যেমন পােড়ারমুখাে মাস্টার তেমনই পােড়ারমুখাে ছেলে! বই-এর নাম শােন না – ‘আক্কেল গুড়ুম। কেষ্টর শতনাম পাওয়া যায় তাে একখানা আন গে বরং – ও বই ফিরিয়ে দিয়ে আয়।
– সে হবে না পিসিমা, তিনি ওসব বাজে বই লেখেন না। এ হলাে প্রহসন।
– সে আবার কী রে?
– সে তুমি বুঝবে না? গিরিশ ঘােষের নাম শুনেছ?
– সে কে আবার? আমাদের গায়ে তাে ও নামের কেউ নেই। দুগগগাপুরের লােক নাকি?
– সে তুমি বুঝবে না। তিনি আমাদের মাস্টারমশায়ের মতাে প্রহসন বই লেখেন।

পিসিমা ধমক দিয়ে বলতেন – তুই চুপ কর বাপু – বড় পণ্ডিত হয়েছিস তুই! আমি জানি নে – ওঁর গাল টিপলে দুধ বেরােয় উনি জানেন – ফাজিল কোথাকার! ওসব গিরিশ ঘােয সতীশ ঘােষ বুঝি নে – কাল ও বই ফেরত দিয়ে কেষ্টর শতনাম আনতে পারিস ভালাে, নয়তাে ন আনা ফেরত আনবি – যা —

একদিন উমাচরণ মাস্টার মশায় আমাদের বুঝিয়ে বলেছিলেন, বড়াে বড়াে লেখকরা সবাই প্রথম জীবনে তার মতাে ইস্কুল-মাস্টারি করেছিলেন। কথাবার্তার মাঝখানে আমাদের ক্লাসের সারদা হঠাৎ বলে বসল – আপনার বয়স কত মাস্টারমশাই?

  – কেন রে?
– তাই বলছি।

উমাচরণ মাস্টার তাকে ধমক দিয়ে বসিয়ে দিলেন বটে, কিন্তু আমরা বুঝতে পারলাম ছেলেটার খটকা বাধছে কোথায়। এই বয়সেও যদি এখন উমাচরণ মাস্টার আমাদের এই স্কুলে মাস্টারি করতে রয়ে গেলেন, তবে কোন বয়সে গিয়ে তিনি কোথায় কী বড়াে কাজ করবেন? আমাদের ক্লাসের সতু কিন্তু বলত – মাস্টার মশাই খুব বড়াে পণ্ডিত। ওরকম হয় না।

আমি বললাম – কেন রে?

 – উনি চালতেবাগানের মাঠের ধারে বসে রােজ কী করেন ! বােধ হয় লেখেন। কবিমানুষ কিনা।

আমি একদিন সতুর সঙ্গে দেখতে গেলাম ব্যাপারটা। চালতেবাগান বহুকালের প্রাচীন আম তেঁতুল গাছের ছায়ায় দিনমানেই সন্ধ্যার মতাে অন্ধকার। অনেক রকম মােটা লতা গাছে গাছে জড়াজড়ি করে আছে। বাগান পার হয়েই একটা ছােটো মাঠ, উমাচরণ মাস্টার সে মাঠের ধারে বসে আছেন, বাগানের ছায়ার আশ্রয়ে একটা ছেড়া মাদুর পেতে। মাদুরের ওপর কাগজ বই ছড়ানাে। পাছে উড়ে যায় বলে মাটির ছােটো ছােটো ঢেলা চাপাননা সেগুলাের ওপর। আমরাশ্যাওড়া ঝােপের আড়ালে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলাম, তিনি কখনও উপুড় হয়ে কী লিখছেন, কখনও সামনের মাঠের দিকে চেয়ে কী ভাবছেন, কখনও আপনমনে হাসছেন, বিড় বিড় করে কী বকছেন।

সতু সসম্ভ্রমে চুপি চুপি বললে – দেখলি? কবিমানুষ!
আমি বললাম – কী করছেন?
– লিখছেন।
– বিড় বিড় করে কী বকছেন?
– ও রকম কবিরা করে থাকে।

দুজনে চুপ করে দাঁড়িয়ে কবির কাণ্ড অনেকক্ষণ দেখলাম। এই আমার জীবনে প্রথম একজন জীবন্ত কবির ক্রিয়াকলাপ দেখবার দুর্লভ সৌভাগ্য ঘটল। মনে আছে, শ্যাওড়া ঝােপের পাশেই ছিল বড়াে একটা কতবেল গাছ, তলা বিছিয়ে পড়ে ছিল পাকা পাকা কতবেল। সেই বয়সের লােভ, বিশেষ করে কতবেলের ওপর লােভ দমন করেছিলাম। কবি দেখবার আনন্দে ও বিস্ময়ে। উমাচরণ মাস্টারের বয়স তখন কত? আমার মনে হয় চল্লিশের ওপর। কারণ আমার মায়ের বড়াে ভাই, আমার বড়াে মামা – যার বয়স তখন শুনতাম পঁয়ত্রিশ – তিনি মাস্টারমশায়কে ‘দাদা’ বলে ডাকতেন।

আমরা যেমন নিঃশব্দে সেখানে গিয়েছিলাম তেমনই নিঃশব্দে চলে এলাম মনে বিস্ময় ও আনন্দ নিয়ে। এর পরে উমাচরণ মাস্টার যখন পড়াতেন, তখন হাঁ করে তার দিকে চেয়ে দেখতাম। একজন কবি বটে! উনি ঠিকই বলেছেন – বড়াে বড়াে লােকেরা প্রথম জীবনে মাস্টারি করে। ওঁর বয়স বেশি হয়েছে বটে কিন্তু উনি একজন কবিও তাে হয়েছেন। সারদাটা কিছুই বােঝে না।

বছরখানেক কাটল। আমরা কটি ছেলে উচ্চ প্রাইমারি পরীক্ষা দেবার জন্য তৈরি হয়েছি। সেই বছর উমাচরণ মাস্টার আমাদের নিয়ে রানাঘাটে যাবেন পরীক্ষা দেওয়াতে। চারটি ছেলে – মনে আছে চক্কত্তিদের কানাই, আমি, সতু ও সারদা। দুর্গাপুর থেকে হেঁটে বেরিয়ে শাবলতলার মাঠে যখন পড়েছি, তখন দুপুর গড়িয়ে গিয়েছে।

বড্ড মনে আছে সেই অপরাহ্রে কথাটি। তখন শাবলতলার মাঠে ঝাঁ ঝাঁ করছে রােদুর। মস্ত বড়াে মাঠের এখানে ওখানে কুলগাছশ্যাওড়া-ভঁটা আর বনতুলসীর জঙ্গল। ধুধুকরছে মাঠ যেন সমুদ্রের মতাে, কূলকিনারা নেই কোনাে দিকে। এত বড়াে মাঠ কখনও দেখিনি। দুর্গাপুর থেকে শাবলতলার মাঠ প্রায় দু ক্রোশ আড়াই ক্রোশ পথ। কাছাকাছি কোনাে গ্রাম নেই এ মাঠের কোনাে দিকে। একটা সরু মেঠো পথ মাঠের মধ্যে দিয়ে দূরে কোথায় চলে গিয়েছে। কী একটা ফুলের গন্ধ বেরুচ্ছে দুপুরের রােদে। আমরা সবাই ছেলেমানুষ, ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। উমাচরণ মাস্টার বললেন – যাও সব গাছতলায় একটু বসে নাও।

আমাদের প্রত্যেকের কঁাধে একটা করে বোঁচকা। তার মধ্যে আমাদের বই-দপ্তর আছে, কাপড় গামছা ও কথা আছে। থাকতে হবে নাকি হােটেলে। আমরা বোঁচকা নামিয়ে একটা কুলগাছের তলায় সবাই বসলাম। মাস্টারমশায় বললেন – দেখাে তাে কুল হয়েছে কিনা।

সতু দেখে বললে – কুল হয়েছে, ছােটো ছােটো – খাওয়া যায় না।

কানাই-এর মা ওকে সেখানে গিয়ে খাবার জন্যে নারকেলের নাড়ু আর রুটি করে দিয়েছিলেন পুটুলিতে। সতু ওর কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে খেলে। আমি চাইতে গেলাম, কানাই বললে, নেই।

আমরা একটু পরে সবাই বোঁচকা রেখে হুটোপাটি করে মাঠের মধ্যে বনতুলসীর জঙ্গলে খেলা করতে লাগলুম। কী সুন্দর যে লাগছিল। ক্ষুদ্র গ্রামের পাড়ায় পাড়ায় খেলা করে বেড়াই, এত বড়াে মাঠের এত ফাকা জায়গায় খেলা করবার সুযােগ কখনও পাইনি। ওদের কেমন লাগছিল জানি না, আমার মনে হচ্ছিল যেন কোনাে নতুন রাজ্যে রূপকথার জগতে এসে পড়েছি – তুলসীমঞ্জরীর সুগন্ধভরা অপরাহ্রে বাতাসে যেন কোন সুদূরের ইঙ্গিত। যে দেশ কখনও দেখিনি, তার কথা কিন্তু আমার মনে সর্বদাই উঁকি দেয়, আজ এই শাবলতলার মাঠে এসে সেই দূর-দূরান্তকে দেখতে পেলাম। ঝােপে ঝােপে শালিক আর ছাতারে পাখির কলরব, এখানে ওখানে বেলে জমিতে খেঁকশেয়ালের গর্ত, রাঙা কেলেঝোড়া ফুলের লতা জড়িয়ে উঠেছে বুনাে কলুচটকা
আর তিত্তিরাজ গাছে, জনমানুষের বাস নেই, একটা কলা গাছ কি আম গাছ চোখে পড়ে না, যেন এ জগতে মানুষের বাস নেই, শুধুই বনঝােপের শুকনাে পাতার ওপর দিয়ে মচ মচ করে পাতার ধুলাে উড়িয়ে এ দেশে চলে যাও, লেখাপড়ার বিরক্তিকর বাধ্যতা এখানে নেই। খেলা ছেড়ে লেখাপড়া করতে কেউ বলবে না এ দেশে। উমাচরণ মাস্টার সেই পুরােনাে, একঘেয়ে, বালকের পক্ষে মহা বিরক্তিকর জগতের মানুষ, এ নতুন জীবনের উদাস মুক্তির মধ্যে, দিনরাতব্যাপী খেলা আর অবকাশের মধ্যে ওঁর স্থান নেই আদৌ।

বেলা পড়ে এসেছে। হঠাৎ সতু বললে – হারে, মাস্টারমশাই কোথায় রে?

আমি বললাম – কেন, কুলতলায় নেই?
-কতক্ষণ তাে তাকে দেখছি নে। গেলেন কোথায়? আমাদের যেতে হবে না ইস্টিশনে? দু ঘণ্টার ওপর তাে এখানে আছি। গাড়ি ধরতে হবে না?

  আমার মনে হচ্ছিল গাড়ি ধরে আর কি রাজা হব আমরা! এই তাে বেশ আছি, উচ্চ প্রাইমারি পরীক্ষার বিভীষিকার মধ্যে না-ই বা গেলাম। ইনসপেক্টর এসে সেবার স্কুলে বলে গিয়েছিল রানাঘাটে গিয়ে পরীক্ষা দেওয়ায় নাকি নানা গােলমাল। খাতায় লিখে পরীক্ষা হয়, গার্ড আছে সেখানে ঘাড়ের ওপর ঝুঁকে, একটু যে দেখাদেখি করবে কী বলাবলি করবে তার কোনাে উপায় নেই। বলাবলি করলেই মহকুমার হাকিমের সামনে নিয়ে গিয়ে হাজির করবে, তিনি জেলও দিতে পারেন, জরিমানাও করতে পারেন। একটু ফিসফাস করবার জো নেই সেখানে। নবমীর পাঁটার মতাে কাঁপতে কাঁপতে ঢুকতে হবে হলঘরে। কী ভীষণ পরিণাম ছাত্রজীবনের! সত্যি বলছি, শাবলতলার মাঠ দেখবার পরে, এখানে এসে এই দু ঘণ্টা ছুটোছুটি করে বেড়ানাের পরে আমি যেন জীবনের সার্থকতা খুঁজে পেয়েছি। তা হচ্ছে এই রকম বিশাল মুক্ত বনময় ধূলিভরা মাঠের অবাধ শান্তি আর স্বাধীনতার মধ্যে খেলা করে বেড়ানাে। পরীক্ষা দিয়ে কী হবে! কানাই এসেও বললে – আমরা যাব কখন? মাস্টারমশাই কোথায়?

সত্যিই তাে, তাঁকে কোনাে দিকে দেখা যাচ্ছে না। সবাই মিলে খুঁজতে বার হওয়া গেল। সতু ডাকতে লাগল – ও মাস্টারমশাই, মাস্টার ম-শা-ই

কোনাে সাড়া নেই।

সতু ভীতুমুখে বলল – বাঘে নিয়ে গেল নাকি রে?

কানাই বললে – দূর, এখানে মানুষখেকো বাঘ থাকবে?

  – না, নেই! তােকে বলেছে!
– তবে গেলেন কোথায়?

আমি বললাম – তােমরা খুঁজে দেখাে। আমি এখানে খেলা করি।

এমন সময় সারদা হাঁপাতে হাঁপাতে এসে বলল – শীগগির – শীগগির আয় – দেখে যা —

আমরা সবাই একসঙ্গে বলে উঠেলাম – কী হয়েছে রে? বেঁচে আছেন তাে?

কথা বলতে বলতেই আমরা সারদার পেছনে ছুটলাম। বেশ খানিকটা দূর দৌড়ে সারদা থেমে পড়ল এবং আঙুল দিয়ে সামনের দিকে দেখিয়ে আমাদের চুপ করতে বলে পা টিপে টিপে এগিয়ে চলল।

একটা শুকনাে খাল-মতাে নীচু জায়গায় কুঁচঝােপের আড়ালে উমাচরণ মাস্টার বসে বসে ঝুঁকে পড়ে লিখতে লিখতে বিড় বিড় করে আপনমনে কী বলছেন, এমন কী আপনমনে ফিক ফিক করে হাসছেনও। যে কেউ দেখলে বলবে উন্মাদ পাগল। অমন তন্ময় হয়ে লিখতে আমরা তাকে কখনও দেখিনি, অমন ভাবে আপনমনে হাসতেও তাঁকে কখনও দেখিনি।

সতু মুগ্ধদৃষ্টিতে সেদিকে চেয়ে বললেন – মাস্টারমশাই একজন আসল কবি।

সারদা ওর মতে মত দিয়ে বললেন – ঠিক তাই।।

  কানাই ও আমি কোনাে কথা না বলে একদৃষ্টে এই সত্যিকার জীবন্ত কবিকে চেয়ে চেয়ে দেখতে লাগলাম। আমাদের কত ভাগ্যি যে আমরা এমন মাস্টার পেয়েছি।

কানাই একটু পরে বললে – কিন্তু ভাই, সন্ধে হলাে। ওঁকে না ডাকলে আমাদের উপায় কী হবে? ডাকি
ওঁকে! কী বলিস?

কেউ সাহস করে না।

সারদার মনে কবির প্রতি শ্রদ্ধা একটু ফিকে, সে দু-একবার আমাদের উপস্থিতি-জ্ঞাপক কাশির আওয়াজ করলে।

সতু চুপি চুপি বললে – এই! আস্তে!

সারদা বললে – হ্যা, আস্তে বই কী! আমরা মরি এখন এই মাঠের মধ্যে সন্ধেবেলা! বাঘে ধরুক সবসুদ্ধ

  – বলে সজোরে একবার কাশির আওয়াজ করতেই উমাচরণ মাস্টার চমকে পেছন ফিরে চাইলেন।

সারদা বললে – আসুন মাস্টারমশাই, সন্ধের দেরি নেই যে – ইস্টিশান এখনও অনেকখানি রাস্তা –

উমাচরণ মাস্টার ব্যস্ত হয়ে খাতাপত্র গুটিয়ে বগলে করে নিয়ে আমাদের কাছে উঠে এলেন শুকনাে খাল থেকে। অপ্রতিভের হাসি হেসে বললেন – তাই তাে, বেলা গিয়েছে দেখছি। চল চল!

তারপর পেছনদিকে চেয়ে বললেন – জায়গাটা বড়াে চমৎকার – না?

সতু সশ্রদ্ধ সুরে বললে – ওখানে কী করছিলেন মাস্টারমশাই? কী আছে ওখানে?

উমাচরণ মাস্টার ধমক দিয়ে বললেন – সে কী তুই বুঝবি? সিনারি কাকে বলে জানিস? চমৎকার সিনারি ওখানটাতে। কবিতা লিখছিলাম। কী চমক্কার মাঠটা, বুঝিস কিছু?

  আমারও চোখে যে এই অপরাহুে এই মাঠ অদ্ভুত ভালাে লেগেছে, মাস্টারমশায়ের কথার মধ্যে তার সায় পেয়ে আমার মন খুশিতে ভরে উঠল। আমি নতুন দৃষ্টি পেলাম সেই দিনটিতে, উচ্চ প্রাইমারি পরীক্ষা দিতে যাবার পথে। উমাচরণ মাস্টার কত বড়াে শিক্ষকের কাজ করলেন সেদিন – তিনি নিজেও কি তা বুঝলেন?

আমার কথা এখানেই শেষ। উমাচরণ মাস্টারের ইতিহাসও এখানেই শেষ। প্রায় ত্রিশ-বত্রিশ বছর আগের কথা সেসব। উমাচরণ মাস্টার আজ আর বােধ হয় বেঁচে নেই। বড়াে হয়ে উমাচরণ চক্রবর্তী বলে কোনাে কবির লেখা কোথাও পড়িনি বা কারও মুখে নামও শুনিনি। তাতে কিছু আসে যায় না। যশােভাগ্য সকলের কি থাকে!

আজ এতকাল পরে শাবলতলার মাঠে এসে আবার মনে পড়ে গেল বাল্যের সেই অপূর্ব অপরাহের কথা, মনে পড়ে গেল উমাচরণ মাস্টারকে। দুঃখ হলাে দেখে – সে শাবলতলার মাঠ একেবারে ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। মুছে গিয়েছে সে সৌন্দর্য, সে নির্জনতা। উমাচরণ মাস্টারের জন্যে মনটা এতদিন পরে যেন কেমন করে উঠল।


বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৪ – ১৯৫০) : জন্মস্থান বনগ্রাম, চব্বিশ পরগনা। বাল্য ও কৈশাের দারিদ্র্য, অভাব ও অনটনের মধ্যে কেটেছিল। জীবিকার ক্ষেত্রে তার অভিজ্ঞতা ছিল ব্যাপক ও বহুধা বিস্তৃত, শিক্ষাকতাও করেছেন দীর্ঘদিন। পল্লী-প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দৰ্য্য তাকে মুগ্ধ করত। প্রবাসী’ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘উপেক্ষিতা’ গল্প দিয়ে তাঁর কথাসাহিত্যিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ। তার অন্যতম বিখ্যাত রচনা পথের পাঁচালী’ বইটি ভাগলপুরে লেখা। মাত্র একুশ বছরের সাহিত্য-জীবনে তিনি অনেক গল্প, উপন্যাস, ভ্রমণ কাহিনি, দিনলিপি এবং শিশু সাহিত্য রচনা করেছেন। তার উল্লেখযােগ্য বইগুলির মধ্যে রয়েছে— ‘বনে পাহাড়ে’, ‘মরণের ডঙ্কা বাজে’, ‘হিরে মানিক জ্বলে, ‘চাঁদের পাহাড়’, ‘আরণ্যক’, ‘অপরাজিত’, ‘ইছামতী’, ‘দেবযান’, ‘আদর্শ হিন্দু হােটেল’, ‘দৃষ্টিপ্রদীপ’, ‘কিন্নরদল’ইত্যাদি। ‘উৎকর্ণ’, ‘স্মৃতির রেখা’, ‘অভিযাত্রিক’ প্রভৃতি হলাে তার দিনলিপি জাতীয় রচনা। তার লেখায় পল্লী-প্রকৃতি এবং অরণ্য-প্রান্তর যেমন আশ্চর্য সজীবতা লাভ করেছে তেমনই গ্রামবাংলার দুঃখ, দারিদ্র, স্বপ্ন, আশা ও আকাঙকাতার লেখায় প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে। ১৯৫১ সালে তাকে মরণােত্তর ‘রবীন্দ্র পুরস্কার প্রদান করা হয়।


[sc name=”last”]