আমফান ঘূর্ণিঝড় রচনা বাংলা
বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড় আমফান-২০২০ : প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া
ভূমিকা:
দানবীয় সাইক্লোন আমফান (Umpun)-এর রাক্ষুসে কামড় ও রেখে যাওয়া দগদগে ক্ষত ও ধ্বংসলীলার স্বরূপ উপলব্দি করতে গিয়ে মনে আসছে সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত-র ঝড়’ কবিতার কয়েকটি পঙক্তি—ঝড় রুষিয়ে / ধায় ঢুসিয়ে / ফোস ফুঁসিয়ে / খুব হুঁশিয়ার। আবহাওয়া দপ্তর পূর্ব থেকে হুঁশিয়ারি দিয়েছিল, ছিল উপযুক্ত সরকারি ব্যবস্থাপনাও। কিন্তু ঝড়ের সেই বিধ্বংসী রূপের কাছে মানুষ আর একবার হার মানল এবং ১৮৫ কি.মি. গতিতে ২০শে মে, ২০২০ রাতের নিকষ অন্ধকারে, কোভিড-১৯ এর লকডাউন-এর সময় দুই মেদিনীপুর, দুই চব্বিশ পরগনা, কলকাতা ও হাওড়া, হুগলিতে ও অন্যান্য জেলায় প্রচণ্ড তাণ্ডব চালিয়ে মানুষকে ভয়াবহ বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিল এই ঘূর্ণিঝড়–যা ২০০৯-এর ‘আয়লা’র বীভৎসতাকেও হার মানিয়েছে।
আস্ফান কী
আস্ফান একটি ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড়–যা ভয়ংকরতার নিরিখে এই শতাব্দীর সেরা ঘূর্ণিঝড়। এর ইংরেজি শব্দ UMPUN একটি থাই (থাইল্যান্ড) শব্দ—যার অর্থ হল আকাশ। ২০০৪ সালে ঘূর্ণিঝড় আস্ফানের নামকরণ প্রস্তাব করে থাইল্যান্ড—যা আরবসাগর ও বঙ্গোপসাগর তীরবর্তী রাষ্ট্রগুলাের সহমতের ভিত্তিতে নির্ধারিত হয়। ১৬ মে উৎপত্তি হয়ে এই ঝড় বিলুপ্ত হয় ২১শে মে, ২০২০তে।
স্বরূপ:
এই ঘূর্ণিঝড় সুপার সাইক্লোনে পরিণত হওয়ার কারণ হল মায়ানমার সংলগ্ন একটি বিপরীত ঘূর্ণাবর্ত। তার ঘেরাটোপেই ঘূর্ণিঝড় হওয়ার পর ধীরগতিতে এগিয়েছে আস্ফান এবং গতি ধীর থাকায় দফায় দফায় তা শক্তিও সঞ্চয় করে। কারণ ১৮ মে বিকেল সাড়ে পাঁচটায় দীঘা থেকে এই ঝড় ১২০০ কিমি. দূরে ছিল তা ৪৮ ঘণ্টায় মাত্র ৩৪০ কিমি. সরে যায় এবং পরের ৪৮ ঘণ্টায় ৮৬০ কিমি. পথ পেরিয়ে সরাসরি পশ্চিমবাংলার উপকূলবর্তী অঞলে ঢুকে পড়ে। দ্রুতগতি না থাকলে তা আরাে বেশিক্ষণ তাণ্ডব চালাতে পারত। ঘূর্ণিঝড়ের লেজ-এর ঝাপটে মেদিনীপুর, দুই চব্বিশ পরগনা, কলকাতা, হুগলি ও হাওড়ায় তা ভয়ঙ্কর রূপ নেয়—সঙ্গী হয় ভারী বৃষ্টি। এর সর্বোচ্চ গতি ঘণ্টায় ২৭০ কিমি. ৩ মিনিট ও ২৮০ কিমি. ১ মিনিট স্থায়ী হয়েছিল—যখন মনে হয়েছিল বাড়িগুলাে দুলছে ও গাছপালা এবং বাড়িগুলাে যেন ঝড়ের সঙ্গী হতে চায়।
প্রকৃতি:
বাংলায় আঘাত করা ঘূর্ণিঝড়গুলির মধ্যে তীব্রতার নিরিখে ১৫৮২ সালের পর এটি পঞম। ২০ মে-র বিকেল থেকে এই ঝড় তাণ্ডব দেখাতে শুরু করেছিল এবং সন্ধ্যা ৬টা থেকে ৯টা পর্যন্ত, কোথাও ভাের পর্যন্ত তাণ্ডব চলেছিল—যার তুলনা নাকি ১০০ বছরেও পাওয়া যায় না। পূর্ব কলকাতা ঘেঁষে বেরিয়ে গিয়েছিল ঘূর্ণিটা। তারপরে রাজারহাট, মিনাখাঁ, হাড়ােয়া, বাদুড়িয়া, বসিরহাট, স্বরূপনগর, গাইঘাটা—এই অক্ষ ধরেই আস্ফান এগিয়ে চলে উন্মত্তের মতাে। সম্পূর্ণ নিষ্প্রদীপ, চারিধারে নিচ্ছিদ্র অন্ধকার, কানে তালা লাগানাে ঝিঝির ডাক আর কোলাব্যাঙের নিরন্তর গােঙানি। একে কৃয়পক্ষের রাত, তারপর ঘন কালাে আকাশ-রাস্তা জুড়ে মহীরূহের পতন এবং সঙ্গে ভয়, নিরাশ্রয়তা এবং অনেকের সর্বস্ব হারানাের স্মৃতিতে ভরপুর হয়ে থাকবে এই সর্বগ্রাসী । বৃষ্টি—ভয়াবহ, গা ছমছমে এক রাত। রাস্তায় উপড়ে পড়েছে বিদ্যুতের খুঁটি, টিনের চাল। এবং দুধারের অন্ধকার চিরে প্রকৃতির সেই রুদ্ররােষের আভাস। খােলা আকাশের নিচে আশ্রয় হারিয়ে অনেক নিরাশ্রয় মানুষ—যেন এক শ্মশানের ভয়াবহতাকে নিরীক্ষণ করছে।
ক্ষয়ক্ষতি:
গােদের উপর বিষফোঁড়ার মতাে কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে আর এক দুর্যোগ আমান। সমগ্র বঙ্গবাসীকে আতঙ্কের মধ্যে পৌঁছে দিল। চারিদিকে পরিযায়ী শ্রমিকের নিরন্নতা, বেসরকারি ক্ষেত্রে কর্মী ছাঁটাই, করােনার মতাে রােগকে মােকাবিলা করা, তার উপর দুর্যোগ—জনজীবন অবরুদ্ধ, লক্ষ লক্ষ মানুষের আশ্রয়হীনতা ও নিরন্নতা—এই হল ঘূর্ণিঝড়ের নীটফল। কেননা চাষির ফসল নষ্ট,। মাঠে নােনা জল, ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত, স্বজন হারানাে এবং সর্বোপরি ভয় ও আতঙ্ক মানুষকে গ্রাস করেছিল। বিদ্যুৎ, ইন্টারনেট, টেলি যােগাযােগ, মােবাইল পরিষেবা, রাস্তাঘাট সবই বিপর্যস্ত। প্রবীণ নাগরিক, অসুস্থ ব্যক্তিরা বিদ্যুতের, পানীয় জলের অভাবে একাকিত্বে পর্যবসিত হয়েছিল। সুযােগ বুঝে জেনারেটারওয়ালারা মুনাফা লুঠেছেন। বিগত আড়াই দশকে সবুজ প্রায় ১৬ শতাংশ কমে গিয়েছিল। আমফান আরাে ৭ শতাংশ কমিয়ে দিল। গাছগুলাে উপড়ে ও ভেঙে দিয়ে, শুধু কলকাতা শহরে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার গাছ উপড়ে গিয়েছে, মাটি ক্ষয় হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্যাসিফিক ডিজাস্টার সেন্টারের মতে-বাংলাদেশ ও ভারতের প্রায় ৩.৮৯ কোটি মানুষের ক্ষতিসাধন করে এই ঝড়। মৃত্যু হয়েছে ৮৮ জনের। পশু পাখি, গৃহপালিত জন্তু ভেসে গিয়েছে। ক্ষতি হয়েছে সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ অঞলের, কৃষিতে ধান, তিল, সবজি এবং পুকুরের মাছের ক্ষতি হয়েছে।
ত্রাণ ও উদ্ধারকার্য:
যে কোনাে বিপর্যয়ের ক্ষেত্রে প্রধান কাজ হল ত্রাণ ও পুনর্বাসন। সেদিক থেকে কোভিড পরিস্থিতিতেও দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে সরকার ও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। মুখ্যমন্ত্রী দ্রুতগতিতে, প্রশাসনিক তৎপরতায় দুর্গত অঞ্চলে খাদ্য, আশ্রয়ের ব্যবস্থা, ঔষধপত্র, বিদ্যুৎ, রাস্তাঘাট পরিষ্কার প্রভৃতির কাজ সম্পন্ন করে দুর্গত মানুষদের পাশে থেকেছেন। হেলিকপ্টার, স্পিডবােট নামিয়ে দুর্গতদের উদ্ধার করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী ঝড় বিধ্বস্ত অঞ্চল পরিদর্শন করেছেন মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে এবং হাজার। কোটি টাকা সাহায্য দিয়েছেন। পুনর্বাসনের লক্ষ্যে ও দুর্গতদের সাহায্যার্থে সরকার দ্রুত ব্যবস্থা নিয়েছেন, সরাসরি দুর্গতদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে অর্থ সাহায্য করেছেন।
রাজনীতি:
পশ্চিমবঙ্গ দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতির প্যারাডাইস। অনেক নেতা অপেক্ষা করে থাকেন। এই ধরনের বিপর্যয়ের জন্য। ঝড় তাদের টাটকা ইস্যু তুলে দিয়ে যায় এবং সংবাদ মাধ্যম হয় তাদের দোসর। রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয় আর উলুখাগড়ার প্রাণ। যায়। কারণ ভােটের জ্বালা বড় জ্বালা। ২০২১-এ নির্বাচন থাকায় নেতারা কোভিড-১৯-কে পরােয়া না করে নেমে পড়েন রাজনীতিতে। ত্রাণ নিয়ে দলবাজির। অভিযােগ ওঠে, স্বজন-পােষণের কথাও ওঠেটিকে থাকে তর্ক ও বিতর্ক।
উপসংহার:
২০২০ সাল-এর আমফান ঘূর্ণিঝড় করােনা পরিস্থিতিতে সকলের কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। প্রকৃতির কাছে মানুষের অসহায়তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে আমফান। প্রাণহানি, শস্যহানি, ক্ষয়ক্ষতি, আতঙ্ক, ভয় , নিরাশ্রয়তা এবং অনেকের সর্বস্ব হারানাের স্মৃতিতে ভরপুর হয়ে থাকবে এই সর্বগ্রাসী। ভয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড় আস্ফান।
[su_posts template=”templates/list-loop.php” tax_term=”1392″ order=”desc”]
